0
বিয়ের আগে পরিবার পরিজন, আত্মীয় স্বজন সংক্রান্ত যাবতীয় খোঁজ খবর নিয়ে
থাকি আমরা, কিন্তু ভুলে যাই সব চেয়ে প্রয়োজনীয় ব্যাপার স্বামী স্ত্রীর
ব্লাড গ্রুপ সংক্রান্ত ব্যাপার টি। আসুন জেনে নেয়া যাক এই বিষয়ে জরুরী
কিছু তথ্য।
 প্রথমেই বলি বিয়ের আগেই কেন বর কনের রক্ত পরীক্ষা করা জরুরী, মুলত নিন্ম বর্ণিত দুই কারণে রক্ত পরীক্ষা আবশ্যক। 
১. রক্তের অসামঞ্জস্য সমস্যা প্রতিরোধে।
২. থ্যালোসেমিয়া প্রতিরোধে

রক্তের অসামঞ্জস্য সমস্যা প্রতিরোধে বা ABO Incompatibility

 
স্বামী-স্ত্রীর ব্লাড গ্রুপ কেমন হওয়া উচিত সে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার
আগে প্রথমে আমাদের ব্লাড গ্রুপ সম্পর্কে কিছু কথা জানা দরকার। প্রধানত
ব্লাড গ্রুপ কে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। একটা হল ABO system (A, B, AB & O),
আরেকটা হল Rh factor {Rh positive( ve) & Rh negative(-ve)}. অর্থ্যাৎ Rh
factor ঠিক করবে ব্লাডগ্রুপ পজেটিভ হবে না নেগেটিভ হবে। তাহলে ব্লাড
গ্রুপগুলো হলঃ A ve, A-ve, B ve, B-ve, AB ve, AB-ve O ve, O-ve.
জেনে নেয়া যাক, যদি অন্য গ্রুপের ব্লাড কারো শরীরে দেওয়া হয় তাহলে কী হবে? যখন কোনো Rh নেগেটিভ গ্রুপের ব্যক্তিকে Rh পজেটিভ গ্রুপের ব্লাড দেয়া হয় তখন প্রথমবার সাধারনত কিছু হবে না। কিন্তু এর বিরুদ্ধে রোগীর শরীরে এন্টিবডি তৈরী হবে যার ফলে যদি কখনো রোগী আবার পজেটিভ ব্লাড নেয় তাহলে তার ব্লাড cell গুলো ভেঙ্গে যাবে, এর কারনে অনেক সমস্যা হবে। যেমন জ্বর,
কিডনি ফেইলিউর, হঠাৎ মৃত্যু ইত্যাদি। এই সমস্যাকে মেডিকেল টার্ম এ বলা হয়
ABO incompatibility.


স্বামী-স্ত্রীর ব্লাডগ্রুপ কী রকম হওয়া দরকার?
স্বামীর ব্লাডগ্রুপ যদি পজেটিভ হয় তাহলে স্ত্রীর ব্লাডগ্রুপ ও পজেটিভ হতে
হবে। আর যদি স্বামীর ব্লাডগ্রুপ নেগেটিভ হয় তাহলে স্ত্রীর ব্লাডগ্রুপ
পজেটিভ বা নেগেটিভ যে কোনো একটি হলেই হবে। তবে স্বামীর ব্লাডগ্রুপ যদি
পজেটিভ হয় তাহলে কোনোভাবেই স্ত্রীর ব্লাডগ্রুপ নেগেটিভ হওয়া চলবে না।
এক্ষেত্রে যদি স্ত্রীর ব্লাডগ্রুপ নেগেটিভ হয় তাহলে তার স্বামীর
ব্লাডগ্রুপ ও নেগেটিভ হতে হবে।


যদি স্বামীর ব্লাডগ্রুপ পজেটিভ হয় আর স্ত্রীর ব্লাডগ্রুপ নেগেটিভ হয়
তাহলে কী সমস্যা হবে?
রক্তের গ্রুপ মিলে গেলে কোন সমস্যা হয় না। তবে স্ত্রী যদি নেগেটিভ হয় আর
স্বামী যদি পজিটিভ হয় তাহলে 'লিথাল জিন' বা 'মারন জিন' নামে একটি জিন
তৈরি হয় যা পরবর্তীতে জাইগোট তৈরিতে বাঁধা দেয় বা জাইগোট মেরে ফেলে।সে
ক্ষেত্রে মৃত বাচ্চার জন্ম হয়। যদি স্বামীর ব্লাডগ্রুপ পজেটিভ হয় তাহলে
সাধারনত বাচ্চার ব্লাডগ্রুপ ও পজেটিভ হবে। যখন কোনো নেগেটিভ
ব্লাডগ্রুপের মা ধারন করবে পজেটিভ Fetus(ভ্রুন) তখন সাধারনত প্রথম
বাচ্চার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু ডেলিভারির সময় পজেটিভ
Fetus এর ব্লাড, placental barrier ভেধ করে এবং placental displacement
এর সময় মায়ের শরীরে প্রবেশ করবে। মায়ের শরীরে ডেলিভারির সময় যে ব্লাড
প্রবেশ করবে, তা ডেলিভারি হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই মায়ের শরীরে Rh
এন্টিবডি তৈরী করবে। যখন মা দ্বিতীয় সন্তান বহন করবে, তখন যদি তার fetus
এর ব্লাডগ্রুপ পুনরায় পজেটিভ হয়। তাহলে মায়ের শরীরে আগে যেই Rh এন্টিবডি
তৈরী হয়েছিলো সেটা placental barrier ভেধ করে বাচ্চার শরীরে প্রবেশ করবে।
আর যখন fetus এর শরীরে Rh antibody ঢুকবে তখন fetal এর RBC এর সাথে
agglutination হবে, যার ফলে RBC ভেঙ্গে যাবে। একে মেডিকেল টার্ম এ "Rh
incompatibility" বলে

 থ্যালাসিমিয়া একটি বংশগত রোগ এবং জিন (Gene) বাহিত। পিতা-মাতার মাধ্যমে সন্তানেরা পেয়ে থাকে। থ্যালাসিমিয়া শব্দটির উৎপত্তি গ্রিক শব্দ Thalassa থেকে। যার অর্থ সমুদ্র। ভূমধ্যসাগর সন্নিহিত অঞ্চলে এ রোগটির প্রাদুর্ভাব বেশি । এজন্য একে থ্যালাসিমিয়া বলা হয়। বংশানুক্রমিক ভাবে এ রোগটি বংশধরদের মধ্যে প্রবেশ করে। জিনের (Gene) মাধ্যমে মূলত এ রোগটি পিতা মাতা থেকে সন্তানে প্রবেশ করে। পিতা ও মাতার কাছ থেকে সন্তানরা এই রোগের একটি করে মোট দুইটি রোগ বাহিত জিন গ্রহণ করলে নিজেরা রোগাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। পিতা মাতা আক্রান্ত অথবা বাহক উভয়ই হতে পারেন। বাহক অবস্থায় তাদের রোগের কোনো লক্ষণ থাকে না। তবে তারা তাদের সন্তানদের মধ্যে এই রোগ ছড়িয়ে দিতে পারেন। এটা কোনো ছোঁয়াচ বা সংক্রামক রোগ নয়। এজন্য একজনের কাছ থেকে অন্যজনের কাছে খাবার, পানীয়, বাতাস, কাপড়-চোপড় ইত্যাদির মাধ্যমে ছড়ায় না। থ্যালাসিমিয়া রোগের প্রধান কারণ লোহিত রক্তকণিকার হিমোগ্লোবিন স্বাভাবিক ভাবে তৈরি না হওয়া। এর ফলে হিমোগ্লোবিনের প্রধান কাজ অক্সিজেন কোষ গুলোতে পৌঁছে দেয়া এবং কার্বনডাই অক্সাইড কোষ থেকে নিয়ে শরীরের বাইরে বের করে দেয়ার কাজ বাধাগ্রস্থ হয়।

শরীরে রক্ত উৎপাদন ব্যবস্থা এবং উপকরণ ঠিক থাকার পরও হিমোগ্লোবিনের ত্রুটির জন্য রক্তের কাজ বাধাগ্রস্থ হয়। ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিন সহ লোহিত রক্ত কণিকা গুলো তাদের স্বাভাবিক ব্যাপ্তিকাল 120 দিন পূর্ণ হওয়ার পূর্বে্ ধ্বংস হয়ে যায়। যার ফলে রক্তাল্পতা, বিশেষ ভাবে রক্তের লাল কণিকার মাত্রাতিরিক্ত ক্ষয়জনিত কারণে রক্তাল্পতার লক্ষণ (Haemolytic Anaemia) এ রোগে দেখা যায়।
  

থ্যালোসেমিয়া প্রতিরোধে রক্ত পরীক্ষা 

থ্যালাসেমিয়া হলো বংশানুক্রমে পাওয়া রক্তের একটি সমস্যা বা রোগ। রক্তে যদি স্বাভাবিক হিমোগ্লোবিন কম থাকে তাহলে থ্যালসেমিয়া হয়। এর ফলে রক্তশুণ্যতাও দেখা দিতে পারে। থ্যালাসেমিয়া গুরুতর না হলে চিকিৎসার তেমন প্রয়োজন নেই। তবে থ্যালাসেমিয়া মারাত্মক আকার ধারণ করলে রুগীর শরীরে নিয়মিত রক্ত দিতে হয়।



থ্যালাসেমিয়া হয়েছে কি করে বুঝবেন/ থ্যালাসেমিয়া আছে কিনা কি করে বুঝবেন?

রোগের লক্ষণসমূহ নির্ভর করে রোগটা কেরিয়ার (Trait) না ডিজিজ (Homozygous State) এর উপর। কেরিয়ারের বেলায় কমবেশী রক্তশূন্যতা থাকে, অনেক সময় হালকা জন্ডিসও থাকতে পারে। কিন্তু থ্যালাসেমিয়া মেজর বা ইন্টারমেডিয়া এর বেলায় রক্তশূন্যতা, জন্ডিস এবং প্লীহা বড় থাকতে পারে। জন্ডিস এর লক্ষণ থাকাতে অনেকে লিভারের সমস্যা মনে করেন। এছাড়া বাচ্চাদের শরীর বৃদ্ধির ব্যাঘাত ঘটে ও ঘনঘন ইনফেকশন হতে পারে। পিত্তে পাথর হওয়ার প্রবণতা থাকে। শরীরে অধিক পরিমাণে আয়রন জমা হয়ে ডায়াবেটিক, হার্টের সমস্যা ও লিভার সিরোসিস এর মত জটিলটা দেখা দেয়। কেরিয়ার রোগীদের বেলায় ভুল চিকিৎসার কারণে শরীরে অধিক আয়রন জমা হয়ে নানা ধরনের জটিলটা দেখা দিতে পারে।
থ্যালাসেমিয়ার ধরণ এবং এর তীব্রতার উপর নির্ভর করে এর উপসর্গগুলো ভিন্ন হয়ে থাকে।

জিনগত সমস্যার কারণে হয় বলে এ রোগ সাধারণত শৈশবেই দেখা দেয়। রক্তশূন্যতা, জন্ডিস, বারবার বিভিন্ন জীবাণুর সংক্রমণে অসুস্থ হয়ে পড়া এবং শিশুর বৃদ্ধি সঠিকভাবে না হওয়া থ্যালাসেমিয়ার লক্ষণ। এসব রোগীর মুখের গড়নেও কিছু অস্বাভাবিকতা দেখা দিতে পারে। সাধারণত যকৃৎ ও প্লীহা বড় হয়ে যায়। রক্তশূন্যতা খুব বেশি হলে হূৎপিণ্ড তার কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে পারে এবং রোগীর শ্বাসকষ্টসহ অন্যান্য উপসর্গ হতে পারে।
থ্যালাসেমিয়া হলে সাধারণত: যেসব লক্ষণ ও উপসর্গগুলো দেখা যায়:
§  অবসাদ অনুভব
§  দূর্বলতা
§  শ্বাসকষ্ট
§  মুখ-মন্ডল ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া
§  অস্বস্তি
§  ত্বক হলদে হয়ে যাওয়া (জন্ডিস)
§  মুখের হাড়ের বিকৃতি
§  ধীরগতিতে শারীরিক বৃদ্ধি
§  পেট বাইরের দিকে প্রসারিত হওয়া বা বৃদ্ধি পাওয়া
§  গাঢ় রঙের প্রস্রাব
§  মুখের হাড়ের বিকৃতি
§  নাকের হাড় বসে যাওয়া (চাইনিজদের মতো চেহারা)
§  শারীরিক বৃদ্ধি কমে যাওয়া

কীভাবে রোগ নির্ণয় করা যায়ঃ
যদি কারও উপরের লক্ষন গুলো অথবা অ্যানিমিয়া/ রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কম থাকে, তাহলে চিকিত্সকের পরামর্শ অনুযায়ী রক্তের পরীক্ষা করিয়ে নিশ্চিত হতে হবে যে এটা থ্যালাসেমিয়া কিনা। যদি থ্যালাসেমিয়া হয়ে থাকে তবে মাইনর নাকি মেজর সেটাও নিশ্চিত হতে হবে। এরপরেই চিকিৎসার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। থ্যালাসেমিয়া মাইনর বা বাহক শনাক্তকরণের জন্য যে রক্ত পরীক্ষা করতে হবে তার নাম, হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোফোরেসিস।
বারডেমে, সি.এম.এইচ, পিজি, কেয়ার হসপিটাল, পদ্মা ডায়াগনোস্টিক ও
আই.সি.ডি.ডি.আর.বিতে এ পরীক্ষা করানো
হয়। খরচ পরবে ৮০০-৯০০ টাকা।


*** থ্যালাসেমিয়া হওয়ার কারন/ থ্যালাসেমিয়া কেন হয়?
থ্যালাসেমিয়া হল হিমোগ্লোবিন রক্তের খুবই গুরত্বপূর্ণ উপাদান। আমরা নিশ্বাসের সঙ্গে যে অক্সিজেন বহন করি, হিমোগ্লোবিনের কাজ হলো তা শরীরের সমস্ত অংশে বহন করে নিয়ে যাওয়া। হিমোগ্লোবিন তৈরী হয় দুটি আলফা প্রোটিন ও দুটি বিটা প্রোটিন দিয়ে।
যদি এই প্রোটিন গুলোর উৎপাদন শরীরে কমে যায়, তবে শরীরের হিমোগ্লোবিনের উৎপাদনও কমে যায় এবং থ্যালাসেমিয়া দেখা দেয়। আলফা ও বিটা প্রোটিন তৈরী হয় জীন হতে। কেউ যখন কোন ত্রুটিপূর্ণ জীন তার বাবা- মায়ের কাছ হতে বংশানুক্রমে পায়, তখনই মূলত থ্যালাসেমিয়া দেখা দেয়। সুতরাং থ্যালাসেমিয়া একটি বংশগত রোগ। ত্রুটিপূর্ণ জীন বহন কারীর তাই এটি প্রতিরোধের কোন উপায় নেই।
জিনগত সমস্যার কারণে থ্যালাসেমিয়া হয়। জিনগত সমস্যার কারণে রক্তের হিমোগ্লোবিনের কোনো কোনো চেইন তৈরি হয় না। হিমোগ্লোবিনের আলফা বা বিটা চেইন যেকোনোটি তৈরিতে সমস্যা হতে পারে। সেখান থেকে এ রোগের সূত্রপাত। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে বিটা থ্যালাসেমিয়া রোগীর সংখ্যাই বেশি, অর্থাৎ বেশির ভাগ রোগীরই হিমোগ্লোবিনের বিটা চেইন তৈরিতে সমস্যা হয়।
তবে হিমোগ্লোবিনের কোনো নির্দিষ্ট চেইন তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় দুটি জিনের মধ্যে একটিতে যদি কারও সমস্যা হয়, তাহলে এই রোগে আক্রান্ত হবেন না, কিন্তু তিনি হবেন এই রোগের একজন বাহক। এই রোগের বাহকদের সাধারণত তেমন কোনো সমস্যা থাকে না। তবে একজন বাহক যদি পরবর্তীকালে অন্য একজন থ্যালাসেমিয়া বাহকের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন, তাহলে তাঁদের সন্তানের থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রবল।

কি ধরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে 
§  রক্ত পরীক্ষা
§  গর্ভাবস্থায়  পরীক্ষা

*** থ্যালাসেমিয়া রোগের চিকিৎসাঃ  মৃদু থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে লক্ষণ ও উপসর্গ খুবই কম থাকে এবং এক্ষেত্রে খুবই অল্প চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। বিশেষ ক্ষেত্রে যেমন-কোন অপারেশন হলে বা প্রসবের পর অথবা কোন সংক্রমণ হলে প্রয়োজন বোধে রক্ত দেয়া
(Blood transfusion) লাগতে পারে।
মাঝারি থেকে মারাত্মক থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে, বছরে বেশ কয়েকবার প্রয়োজনবোধে ৮ থেকে ১০ বার রক্ত দেয়া লাগতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন (Bone Marrow transplant) করার প্রয়োজন
হতে পারে।
পাশাপাশি ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ঔষধ সেবন করতে হবে। জীবন-যাপন পদ্ধতি থ্যালাসেমিয়ার রোগীকে বাঁচিয়ে রাখতে দিনের পর দিন রক্ত দিয়ে যেতে হয়। প্রতি ব্যাগ রক্তের সঙ্গে শরীরে জমা হয় আয়রন। এই অতিরিক্ত আয়রন গিয়ে জমে লিভার ও প্যানক্রিয়াস (যেই অংগ থেকে ইনসুলিন তৈরী হয়) এ।  ফলে লিভার সিরোসিস ও ডায়বেটিস (প্যানক্রিয়াস ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে কম ইনসুলিন তৈরী হওয়ার ফলে) দেখা দেয়।
ডাক্তারের নির্দেশনা ছাড়া তাই আয়রণযুক্ত ঔষধ, ভিটামিন বা অন্যকোন ঔষধ খাওয়া যাবে না। সুষম ও পুষ্টিকর খাবার বিশেষ করে ক্যালসিয়াম, জিংক, ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। যাতে অন্য কোন জীবানু দিয়ে আক্রান্ত না হন তার জন্য বারবার হাত ধুতে হবে, অসুস্থ ব্যক্তিদের থেকে দূরে থাকতে হবে, বাইরের খাবার খাওয়া যাবেনা ও সংক্রমণ এড়াবার জন্য বিভিন্ন
রোগের টিকা নি্যে রাখতে হবে।

*** থ্যালাসেমিয়ার প্রকারঃ

হিমোগ্লোবিন তৈরির একটি জীন ভাল এবং একটি মন্দ থাকে তবে হিমোগ্লোবিন স্বাভাবিকের চেয়ে (১০-৫০% ভাগ) কম তৈরি হবে। এ ধরনের রোগীকে থ্যালাসেমিয়া মাইনর (Heterozygous state)  বলে। এদের মধ্যে রোগের লক্ষণ কম মাত্রায় প্রকাশ পায় বিধায় রোগ সহজে ধরা যায়নাকারন এরা ডাক্তারের কাছে দেরীতে আসেন। এদেরকে থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট বা কেরিয়ার (Thalassemia trait বা Carrier) বলে। আর যাদের দুইটি জীনই মন্দ (Defective) অর্থাৎ যাদের মা এবং বাবা উভয়ই থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট তাদের মধ্যে রোগের লক্ষণসমূহ শিশুকালেই প্রকাশ পায়এবং সহজেই রোগ নির্ণয় করা সম্ভব হয়এদেরকে থ্যালাসেমিয়া মেজর (Homozygous state) বা বিশেষ ক্ষেত্রে থ্যালাসেমিয়া ইন্টারমেডিয়া (Thalassemia Intermedia) বলে এরা শিশুকাল থেকেই নানা সমস্যায় ভোগে। হিমোগ্লোবিন গঠন পদ্ধতিতে(Structural Defect) সমস্যা থাকতে পারেযেমন Hb-E, Hb-C, Hb-D, ইত্যাদি। অনেক ক্ষেত্রে এদের সংমিশ্রণও হতে পারেতবে প্রায় সবক্ষেত্রেই বাবা বা মা অথবা উভয়ই দায়ী। বাংলাদেশে হিমোগ্লোবিন-ই (Hb-E) এবং হিমোগ্লোবিন বিটা থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট (Hb-B Trait) এর প্রকোপ বেশী। হিমোগ্লোবিন একটি টেট্ট্রামার প্রোটিন যার দুটি আলফা শিকল ও দুটি বিটা শিকল রয়েছে। আলফা অথবা বিটা শিকলের জিনে মিউটেশন ঘটার কারণে একটি পূর্নাঙ্গ হিমোগ্লোবিন গঠিত হতে পারেনা। আর ত্রুটিপূর্ন্ গঠনযু্ক্ত হিমোগ্লোবিন অক্সিজেন সরবরাহ করতে পারেনা।
 থ্যালাসেমিয়া দুই প্রকার-
১. আলফা থ্যালাসেমিয়াঃ কারো শরীরে আলফা প্রোটিন কম তৈরী হলে তাকে বলা হয় আলফা থ্যালাসেমিয়া।
লঘু আলফা থ্যালাসেমিয়া (ইংরেজীতে থ্যালাসেমিয়া মাইনর) তে আলফা প্রোটিন কিছুটা কম তৈরী হয় আর মারাত্মক আলফা থ্যালাসেমিয়া (ইংরেজীতে থ্যালাসেমিয়া মেজর) তে আলফা প্রোটিন অনেক কম তৈরী হয়।
থ্যালাসেমিয়া মেজর হলে শিশু গর্ভাবস্থায় অথবা জন্মের পরপরই মারা যায়।
২. বিটা থ্যালাসেমিয়াঃ কারো শরীরে বিটা প্রোটিন কম তৈরী হলে তাকে বলা হয়
বিটা থ্যালাসেমিয়া। বিটা থ্যালেমিয়া তে রোগের তীব্রতা আলফা হতে অনেক বেশী। রোগী যদি শিশু হয়
তবে অঙ্গহানী ও মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। লঘু বিটা থ্যালাসেমিয়া (ইংরেজীতে থ্যালাসেমিয়া মাইনর) তে বিটা প্রোটিন কিছুটা কম তৈরী হয় আর মারাত্মক বিটা থ্যালাসেমিয়া (ইংরেজীতে থ্যালাসেমিয়া মেজর) তে বিটা প্রোটিন অনেক কম তৈরী হয়। থ্যালাসেমিয়া মেজর এর চাইতে মাইনর এর তীব্রতা কম। সুতরাং থ্যালাসেমিয়া মেজর ও মাইনর এর জন্য চিকিৎসাও ভিন্ন হয়।
হিমোগ্লোবিন-ই ডিসঅর্ডারঃ 
বিটা থ্যালাসেমিয়ার মত হিমোগ্লোবিন-ই ও আমাদের দেশে বেশ দেখা যায়। এটাও এক ধরনের হিমোগ্লোবিন ডিসঅর্ডার এবং বংশগত রোগ। এই হিমোগ্লোবিন-ই ডিসঅর্ডার দুই ধরনের হয়ে থাকে। ১. হিমোগ্লোবিন-ই ট্রেইট ২. হিমোগ্লোবিন-ই ডিজিজ। যে সন্তানের পিতা-মাতার যে কোন একজন থেকে হিমোগ্লোবিন-ই এর জিন পায়, তাদেরকে হিমোগ্লোবিন-ই এর বাহক (Hemoglobin E-Trait) বলা হয় আর যারা বাবা-মা দু
জনের কাছ থেকেই উত্তরাধিকারসূত্রে এই জিন পায় তারা হিমোগ্লোবিন-ই ডিজিজে আক্রান্ত হয়।
হিমোগ্লোবিন-ই ট্রেইট কিংবা হিমোগ্লোবিন-ই ডিজিজে আক্রান্ত ব্যক্তি যদিও হিমোগ্লোবিন-ই জিন সারাজীবনের জন্য বহন করে, তবুও এদের ক্ষেত্রে তেমন কোন উপসর্গ দেখা দেয় না। এরা অনেকটা বিটা থ্যালাসেমিয়ার বাহকের মতই, সামান্য রক্তশূন্যতায় ভুগতে পারে। তবে দুর্ভাগ্যক্রমে যদি এদের কারো সাথে বিটা থ্যালাসেমিয়ার বাহকের সাথে বিবাহ হয়, তবে তাদের শিশুর হিমোগ্লোবিন-ই বিটা থ্যালাসেমিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

মৃদু থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে 
§  মৃদু থ্যালাসেমিয়ার লক্ষণ ও উপসর্গ খুবই কম থাকে এবং এক্ষেত্রে খুবই অল্প চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।
§  বিশেষ ক্ষেত্রে যেমন-কোন অপারেশন হলে বা প্রসবের পর অথবা কোন সংক্রমণ হলে প্রয়োজন বোধে রক্ত দেয়া (Blood transfusion) লাগতে পারে।

মাঝারি থেকে মারাত্মক থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে
§  বছরে বেশ কয়েকবার প্রয়োজনবোধে ৮ থেকে ১০ বার রক্ত দেয়া লাগতে পারে
§  কিছু কিছু ক্ষেত্রে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন (Bone Marrow transplant) করার প্রয়োজন হতে পারে
§  ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ঔষধ ( আয়রণ ও ফলিক এসিড) ও পথ্য সেবন করা

জীবন-যাপন পদ্ধতি  
§  ডাক্তারের নির্দেশনা ছাড়া আয়রণযুক্ত ঔষধ, ভিটামিন বা অন্যকোন ঔষধ খাওয়া যাবে না
§  সুষম ও পুষ্টিকর খাবার বিশেষ করে ক্যালসিয়াম, জিংক, ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে
§  সংক্রমণ এড়াবার জন্য বারবার হাত ধুতে হবে এবং অসুস্থ ব্যক্তিদের থেকে দূরে থাকতে হবে
§  এছাড়া সংক্রমণ এড়াবার জন্য  টিকা নিতে হবে

প্রতিরোধে করনীয়ঃ 
থ্যালাসেমিয়ার মহামারি হতে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য প্রথম প্রয়োজন থ্যালাসেমিয়া বাহকদের শনাক্তকরণ।
যদি কোনো কারণে দুজন বাহকের বিয়ে হয়েও যায়, তাহলে সন্তান গর্ভধারণের অনতিবিলম্বে গর্ভস্থিত সন্তানের পরীক্ষা করা এবং পরীক্ষায় যদি ধরা পড়ে যে ভ্রূণটি থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত, সেক্ষেত্রে চিকিত্সকের পরামর্শ অনুযায়ী এবং বাবা-মায়ের ইচ্ছায় গর্ভপাত ঘটানো যায়।
দুজন থ্যালাসেমিয়া বাহক যাতে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ না হয় সে বিষয়ে জনগণকে সচেতন করে তুলতে হবে।
সরকারীভাবে থ্যালাসেমিয়াকে একটি অন্যতম স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে জনগণের কাছে তুলে ধরার জন্য যাবতীয় কর্মসূচী গ্রহণ করা জরুরী হয়ে পড়েছে।
বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে এইডস কে যেভাবে সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে জনগণকে সচেতন করা হয়েছে, ঠিক সেভাবেই থ্যালাসেমিয়া রোগী কিংবা বাহকদের কি কি করনীয় তা বিশদভাবে তুলে ধরতে হবে
টেলিভিশন, রেডিও, পত্র-পত্রিকায় পর্যপ্ত প্রচারণা।
ঘন ঘন র্যারলি, প্ল্যাকার্ড, বিলবোর্ড স্থাপন, পোস্টার, লিফলেট এবং বিশেষ ক্রোড়পত্র বিতরণের মাধ্যমে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।
§  যদি আপনার, আপনার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের, স্ত্রীর ও স্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের কারো থ্যালাসেমিয়া রোগের ইতিহাস থাকে তাহলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
§  গর্ভধারণ করার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
§  কোনো মা-বাবার একটি সন্তান যদি থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হয়, তাহলে সেই মা যখন তাঁদের পরবর্তী সন্তানকে গর্ভে ধারণ করবেন, তখন তিনি তাঁর গর্ভের শিশুটিও থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত কি না, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে জেনে নিতে পারেন। এটি জেনে নেওয়া যায় গর্ভকালীন প্রথম তিন মাসের মধ্যেই।
§  আর বিয়ের আগেই পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া উচিত, যেন দুজন থ্যালাসেমিয়া বাহকের মধ্যে বিয়ে না হয়। কারণ, দুজন থ্যালাসেমিয়া বাহকের মধ্যে বিয়ে হলে তাঁদের সন্তানের থ্যালাসেমিয়া হওয়ার আশঙ্কা অত্যন্ত বেশি।
§  সাধারণত থ্যালাসেমিয়া বাহকের মধ্যে রোগের কোনো ধরনের লক্ষণ থাকে না। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাহক যখন গর্ভাবস্থায় থাকেন, তখন তাঁর রক্তশূন্যতা হলে তা আয়রন, ফলিক অ্যাসিড বা অন্য কোনো ওষুধ সেবনের মাধ্যমে ভালো হয় না। এ ছাড়া বাহকের তেমন কোনো সমস্যাই হয় না।
§  থ্যালাসেমিয়া মূলত শিশুদের একটি রোগ। চিকিৎসক ছাড়াও সাধারণ মানুষের এ রোগ সম্পর্কে জানা উচিত। থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে সচেতন হওয়া উচিত সবারই।

থ্যালসেমিয়া প্রতিরোধের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাঃ
বিয়ে করুন রক্ত পরীক্ষা করে, দয়া করে বিয়ের আগেই রক্ত পরীক্ষা করুন, দেখুন আপনি থ্যাসেমিয়ার ক্যারিয়ার কিনা।
পরীক্ষার নামঃ হিমোগ্লোবিন ইলেক্ট্রোপ্রোসিস (Haemoglobin Electrophoresis)
কোথায় করাবেনঃ বারডেমে, পিজি, সেনা হাসপাতালে (এএফআইপি), আইসিডিডিআরবি ও বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালে এ পরীক্ষা করা হয়। খরব পড়বে সর্বোমোট ৪০০ টাকা থেকে ১০০০ টাকা।


*** থ্যালাসেমিয়া রোগের ভয়াবহতাঃ
রক্ত পরিবর্তন অথবা রোগের কারণে রক্তে আয়রণের পরিমাণ বেড়ে
যায়। রক্তে আয়রনের পরিমাণ বেড়ে গেলে তা হৃৎপিন্ড, যকৃত এবং হরমোন ব্যবস্থা কে
ক্ষতিগ্রস্থ করে।
এর লক্ষন প্রকাশিত হতে থাকে
নানাভাবে।
রক্ত পরিবর্তনের কারণে রক্ত বাহিত বিভিন্ন রোগ (যেমন-জন্ডিস, এইচআইভি, হেপাটাইটিস বি
সি ভাইরাসজনিত রোগ) এর সংক্রমণ এর সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
রোগীকে তাই প্রচন্ড সাবধানে চলাফেরা করতে হয় নয়ত যে কোন মুহুর্তে অন্য যে কোন রোগের
জীবানু দ্বারা আক্রান্ত হয়ে যেতে পারে।
§  রক্ত তৈরী হয় হাড়ের ভেতর কার অস্থিমজ্জা (bone marrow) থেকে। শরীর চেষ্টা করে হিমোগ্লোবিন
এর অভাব দূর করতে অনেক বেশী রক্ত তৈরী করতে, ফলে অস্থিমজ্জার উপর বেশী চাপ পরে ও
অস্থিমজ্জা প্রসারিত হয়ে যায়। এর ফলে হাড় পাতলা ও ভঙ্গুর হয়ে যায়। এতে মেরুদন্ডের হাড় ভেঙ্গে যাবার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
নাকের হার বসে গিয়ে, মুখের হার বৃদ্ধি পেয়ে চেহারা বিকৃত হয়ে যেতে পারে।
ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিন পরিষ্কারের কাজে নিয়োযিত থাকে প্লীহা (speen)
প্লীহার উপর অতিরিক্ত কাজের চাপ পরে ও প্লীহা প্রসারিত হয়ে যায়। রোগীর পেটের আয়তন বৃদ্ধি পায়।
মোটকথা আস্তে আস্তে পুরো শারীরিক কার্যক্রমের ব্যালেন্স ই নষ্ট হয়ে যায়।
আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে যা যা করণীয়:
§  নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা করানো
§  আয়রন জাতীয় ঔষধ খাবেন না।
§  অধিক আয়রন জনিত জটিলটা এড়ানোর জন্য ৩-৬ মাস পরপর রক্তরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
§  রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ ১০ গ্রাম বা ডেসিলিটার রাখার চেষ্টা করতে হবে
§  হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের (Hepatitis B Virus) টিকা দেয়া।
§  প্রতি তিন মাস পর পর রোগীর উচ্চতা, ওজন, লিভার ফাংশন টেষ্ট ইত্যাদি পরীক্ষা করানো।
§  আট থেকে ১০ ব্যাগ রক্ত দেওয়ার পর রক্তে লৌহের পরিমাণ নির্ণয় করতে হবে।
§  রক্তে লৌহের মাত্রা এক হাজার ন্যানো গ্রাম বা মিলি লিটারের ওপরে হলে চিকিত্সকের শরণাপন্ন হওয়া।
§  শিশুর প্রতিবছর বুদ্ধি ও বিকাশ পর্যবেক্ষণ করা।
§  অধিক আয়রনযুক্ত খাবার পরিত্যাগ করা।
§  প্রয়োজনে এবং উপসর্গ অনুসারে, ওড়াল গ্লুকোজ টলারেন্স টেষ্ট (Oral Glucose Tolerance Test), রেনাল ফাংশন টেষ্ট (Renal Function Test), হৃদপিণ্ড এবং অন্যান্য এন্ডোক্রাইনোলজিক্যাল (Endocrinological) পরীক্ষা করানো।
§  একজন কেরিয়ার (ট্রেইট) অন্য একজন কেরিয়ার কে বিয়ে করবেন না।
§  মা ও বাবা উভয়ই কেরিয়ার হলে প্রিনেটাল ডায়াগনোসিস এর ব্যবস্থা গ্রহন করুন।

বিয়ের আগে যা করবেনঃ
আপনি যদি থ্যালাসেময়ার রোগী বা বাহক হন, বিয়ের আগে অবশ্যই রক্ত পরীক্ষা করে
জেনে নিন যে আপনার হবু জীবনসঙ্গী ও এই রোগের রোগী বা বাহক কিনা।
কেননা আপনাদের বিয়ে হলে, হবু সন্তান হতে পারে এই রোগের শিকার।
আপনি গর্ভবতী হলে কি করবেন?
বাবা ও মা দুজনেই যদি থ্যালাসেমিয়ার বাহক হয়, তবে প্রতি ৪ জন সন্তানেরর মধ্যে একজনের থ্যালাসেমিয়ার রোগী হওয়ার, দুইজনের থ্যালাসেমিয়ার বাহক হওয়ার এবং একজনের স্বাভাবিক সম্ভাবনা থাকে। সেই ৪ জনের
মধ্যে যে থ্যালাসেমিয়ার রোগী হবে সে আপনার কততম সন্তান তা নিশ্চিত করে বলা যায়না। তাই প্রতিবার গর্ভবতী হওয়ার পরই গর্ভস্থ সন্তান কে পরীক্ষা করান। পরীক্ষার মাধ্যমে জানা যাবে যে শিশুটি এইই রোগের বাহক বা রোগী কিনা। রোগী হলে সে মেজর নাকি মাইনর থ্যালাসেমিয়া তে ভুগছে কিনা। এরপর বাবা-মায়ের
ইচ্ছায় ও ডাক্তারের পরামর্শে শিশুর ভ্রুণ নষ্ট করে ফেলা যেতে পারে
(নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত হলেও, এটা শিশুটাকে একটি দুঃখময় জীবন হতে বাচাবে)। এই  ক্ষেত্রে যে পরীক্ষা গুলো করা হয় সেগুলো হলো :
কোরিওনিক ভিলিয়াস স্যাম্পলিং (Chorionic villus sampling)
অ্যামনিওসেনটিসিস (Amniocentesis)
ফিটাল ব্লাড স্যাম্পলিং (Fetal blood sampling)
ডি.এন.এ সলিশন লিমিটেড
(পান্থপথ) এ,
আপনি গর্ভবস্থায় পরীক্ষার মাধ্যমে শিশুর থ্যালাসেমিয়া নির্ণয় করতে পারবেন। গর্ভাবস্থার ১৬ থেকে ১৮ সপ্তাহের মধ্যে পরীক্ষাটি করালে ভালো হয়। খরচ পরে প্রায় ১৫ হাজার টাকা।
-জেনেটিক রোগ সম্পর্কে সচেতন না থাকা ও আত্মীয়দের মধ্যে বিয়ের কারণে বাংলাদেশ, পাকিস্তান এইসব দেশগুলোতে থ্যালাসেমিয়ার দ্রুত বিস্তার ঘটছে। আমাদের দেশে প্রতিবছর প্রায় আট থেকে দশ  হাজার শিশুর জন্ম হচ্ছে থ্যালাসেমিয়া নিয়ে। ইতঃমধ্যে সারাদেশে আক্রান্তর সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন লাখেরও বেশি শিশু। দেশে এ রোগের বাহক প্রায় দেড় কোটি মানুষ। তাই দ্রুত এই রোগ প্রতিরোধে সবাইকে সতর্ক হতে হবে। আমরা চাইলে আমাদের সমাজ হতে এই রোগ সম্পূর্ণ নির্মূল করতে পারি।
প্রথমত বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষা করে আমরা জীবনসঙ্গী নির্বাচন করতে পারি, যাতে কোনভাবে দুজন বাহকের বিয়ে না হয়ে যায়।
দ্বীতিয়ত, যদি বিয়ে হয়েই যায়, গর্ভস্থ সন্তান কে পরীক্ষা করে, তার জন্মের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এই ভাবে একদম সবাই সচেতন হলে আমাদের সমাজ থেকে ত্রুটিপূর্ণ জীনের বিস্তার ঠেকানো এবং একসময় সম্পূর্ণ
নির্মূল সম্ভব। উল্লেখ্য যে, সাইপ্রাসে যেখানে আগে প্রতি ১৫৮ জন শিশুর একজন ছিলো থ্যালাসেমিয়ার রোগী, গর্ভস্থ পরীক্ষার মাধ্যমে এখন এই রোগীর সংখ্যা শুণ্যে নামানো সম্ভব হয়েছে।

থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগীরা কি কি খাবার এবং ফল খেতে পারবে আর কোনগুলো খেতে পারবে না?

----------------------------------------থ্যালাসেমিয়া বংশগত রক্তস্বল্পতা জনিত রোগ। এই রোগে রোগীকে বারবার রক্ত দিতে হয় বলে দেহে আয়রনের মাত্রা বাড়ে। আয়রন হৃৎপিণ্ডে, যকৃতে, অগ্ন্যাশয়ে জমা হয়। এতে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিকল হতে পারে। তাই এই রোগে আয়রন জাতীয় খাবার খেতে সাধারণত নিষেধ করা হয়। থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের আয়রনযুক্ত খাবার খুবই কম খেতে হবে। পুষ্টিকর খাবার বেশি করে খেতে হবে। ফলিক এসিড, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ডি ও জিংক সমৃদ্ধ খাবার বেশি বেশি করে খেতে হবে। থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের যেসব খাবার একেবারেই খাওয়া চলবে না, সেগুলো সমন্ধে লিখছি l প্রোটিন: মাটন, বিফ, বিন, কলিজা, সেলফিশ, ওয়েস্টার, পিনাট বাটার, পর্ক, টফু, ডিমের কুসুম, বাদাম, সি ফুড l ফল ও সবজি : তরমুজ, বাধাকপি, আলুবোখরা, মটরসুটি, সিমের বিচি, এপ্রিকট, এসপারাগাস, বিনস, ব্রকলি, খেজুর, কলা, কচু, কচুশাক, পেয়ারা অর্থাত যে কোনো আয়রন যুক্ত সবজি আর ফল খাওয়া চলবে না l শস্য : ইনফ্যান্ট সিরিয়ালস, কর্নফ্লেক্স, রেইসিন ব্রান, দানাদার শস্য খাওয়া একেবারেই চলবে না l
নিতে হবে চিকিৎসা: পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর যদি কোনো রোগী থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত বলে শনাক্ত হন, তাহলে তাঁকে চিকিৎসা দিতে হবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শিশুরাই থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হয়, তাই তাদের চিকিৎসা হওয়া উচিত একজন শিশু রক্তরোগ বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে। রোগীকে রক্ত দেওয়ার পাশাপাশি অবশ্যই আয়রন চিলেশন চিকিৎসাও নিতে হবে। তা না হলে রক্তে আয়রনের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে আয়রনের বিষক্রিয়ায় ধীরে ধীরে রোগী মারা যান। আয়রন চিলেশন চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল বলে বাংলাদেশের অধিকাংশ রোগীই তা দীর্ঘদিন পর্যন্ত গ্রহণ করতে সক্ষম হয় না, তাঁরা শুধু মাসে মাসে রক্ত গ্রহণের মাধ্যমে তাঁদের চিকিৎসা সম্পন্ন করেন। ফলে এই রোগীদের দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কমে যায়।
এসব রোগীর আয়রনসমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার ব্যাপারে থাকে বিধিনিষেধ। আর আয়রনসমৃদ্ধ ওষুধ খাওয়া যাবে না একদমই।
লেখক: চেয়ারম্যান, শিশু রক্তরোগ বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।
সচরাচর জিজ্ঞাসা 
প্রশ্ন১. থ্যালাসেমিয়া কেন হয়
উত্তর. ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিন জিনের কারণে থ্যালাসেমিয়া হয়। বাবা অথবা মা, অথবা বাবা- মা উভয়েরই থ্যালাসেমিয়া জীন থাকলে বংশানুক্রমে এটি সন্তানের মধ্যে  ছড়ায়।

প্রশ্ন.২. থ্যালাসেমিয়া কয় ধরণের হয়ে থাকে?
উত্তরথ্যালসেমিয়া প্রধানত দুই ধরণের হয়। যথা :

১. আলফা থ্যালাসেমিয়া (Alpha-thalassemia) : চারটি জিন দিয়ে আলফা থ্যালাসেমিয়া ধারা (Chain) গঠিত হয়। আমরা বাবা-মা প্রত্যেকের কাছ থেকে দুটি করে এই জিন পাই। এই জিনগুলোর মধ্যে এক বা তার অধিক ত্রুটিপূর্ণ হলে Alpha-thalassemia হয়। যত বেশি জিন ত্রুটিপূর্ণ হবে তত বেশি মারাত্মক সমস্যা দেখা দিবে।
যেমন :
§  একটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে থ্যালাসেমিয়ার কোন লক্ষণ ও উপসর্গ দেখা যাবে না। তবে আক্রান্ত ব্যক্তির মাধ্যমে তার সন্তানের মধ্যে এই রোগ ছড়াবে।
§  দুইটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে হালকা উপসর্গ দেখা যাবে। এই অবস্থাকে বলে আলফা থ্যালাসেমিয়া মাইনর (Alpha-thalassemia minor) অথবা আলফা থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট ( Alpha-thalassemia trait).
§  তিনটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে এর উপসর্গগুলো মাঝারি থেকে মারাত্মক আকার ধারণ করে। এই অবস্থাকে বলে হিমোগ্লোবিন এইচ ডিজিজ।
§  চারটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে একে বলে আলফা থ্যালাসেমিয়া মেজর (Alpha thalassemia major) অথবা হাইড্রপস ফিটেইলস (Hydrops fetalis)এর ফলে প্রসবের (delivery) পূর্বে অথবা জিনের পরপর ভ্রূণ নষ্ট হয়ে যায়।

২. বিটা থ্যালাসেমিয়া (Beta-thalassemia) : Beta-thalassemia ধারা গঠিত (Chain) হয় দুইটি জিন দিয়ে। বাবা-মা প্রত্যেকের কাছ থেকে একটি করে মোট দুইটি জিন আমরা পেয়ে থাকি। একটি অথবা উভয় জিনই ত্রুটিপূর্ণ হলে Beta-thalassemia দেখা দেয়।  এক্ষেত্রে :
§  একটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে হালকা উপসর্গ দেখা যায়। এই অবস্থাকে বলে বিটা থ্যালাসেমিয়া মেজর (Beta-thalassemia major) অথবা বিটা থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট (Beta-thalassemia trait).
§  দুইটি জিনই ত্রুটিপূর্ণ হলে মাঝারি থেকে মারাত্মক উপসর্গ দেখা যায়। এ অবস্থাকে বলে বিটা থ্যালাসেমিয়া মেজর ( Beta-thalassemia major) অথবা কুলিস এ্যানিমিয়া (Cooley’s anemia)নবজাতক যেসব শিশুর এই সমস্যা থাকে তারা জন্মের সময় বেশ স্বাস্থ্যবান থাকে। তবে জন্মের প্রথম দুই বছরের মধ্যেই এর উপসর্গ দেখা যায়।

প্রশ্ন.৩. হিমোগ্লোবিন কি?
উত্তর. হিমোগ্লোবিন লাল রংয়ের এবং প্রোটিন সমৃদ্ধ একটি উপাদান যা লোহিত রক্ত কণিকায় বিদ্যামান থাকে। হিমোগ্লোবিন লোহিত রক্ত কণিকাকে ফুসফুস থেকে শরীরের সব অংশে অক্সিজেন সরবরাহে এবং শরীরের অন্যান্য অংশ থেকে ফুসফুসে কার্বন-ডাই- অক্সাইড সরবরাহে সাহায্য করে।

প্রশ্ন.৪. কাদের থ্যালাসেমিয়া হওয়ার ঝুঁকি বেশি রয়েছে
উত্তর. যাদের থ্যালাসেমিয়া হওয়ার ঝুঁকি বেশি রয়েছে তারা হলেন :
§  বাবা মায়ের থ্যালাসেমিয়া থাকলে তাদের সন্তানদের মধ্যেও এই রোগ দেখা দেয়।
§  কিছু কিছু জাতির মধ্যে যেমন-দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা, ইটালী, গ্রীক, মধ্যপ্রাচ্যের মানুষদের মধ্যে থ্যালাসেমিয়া রোগটি বেশী দেখা যায়।

প্রশ্ন.৫. থ্যালাসেমিয়ার ফলে কি ধরণের জটিলতা দেখা দিতে পারে
উত্তর. থ্যালাসেমিয়ার ফলে নিচের জটিলতাগুলো দেখা দিতে পারে :
§  রক্ত পরিবর্তন অথবা রোগের কারণে রক্তে আয়রণের পরিমাণ বেড়ে যায়। রক্তে আয়রনের পরিমাণ বেড়ে গেলে তা হৃৎপিন্ড, যকৃত এবং এন্ডোক্রাইন ব্যবস্থা কে (Endocrine system) ক্ষতিগ্রস্থ  করে।
§  রক্ত পরিবর্তনের কারণে রক্ত বাহিত বিভিন্ন রোগ যেমন-হেপাটাইটিসের সংক্রমণ হয়।
§  অস্থিমজ্জা প্রসারিত হয়ে যায় এবং এর ফলে হাড় পাতলা ও ভঙ্গুর হয়ে যায়। এতে মেরুদন্ডের হাড় ভেঙ্গে যাবার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
§  থ্যালাসেমিয়া লোহিত রক্তক্ষণিকা ধ্বংস করে প্লীহার (Spleen) কার্যকারিতার উপর চাপ ফেলে এবং প্লীহা বড় হয়ে যায় (Spleen Enlargement)

প্রশ্ন.৬. রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে কোন বিষয় গুলো জানা যায়?
উত্তর. রক্তের পরীক্ষার মাধ্যেমে যে বিষয়গুলো জানা যায়:
§  লোহিত রক্তকণিকা কমমাত্রায় (Low level) থাকা
§  লোহিত রক্ত কণিকার পরিমাণ কম থাকা
§  লোহিত রক্ত কণিকার আকার পরিবর্তিত হওয়া
§  বিবর্ণ (Pale) লোহিত রক্ত কণিকা
§  লোহিত রক্ত কণিকায় হিমোগ্লোবিনের অসম থাকা যা মাইক্রোস্কোপে ষাড়ের চোখের মত দেখা যায়

এছাড়া রক্তের পরীক্ষার মাধ্যমে নিচের বিষয়গুলোও জানা যায় :
§  শিশুর রক্তে আয়রণ/লৌহের পরিমাণ
§  হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ
§  ডিএনএ বিশ্লেষণের মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়া আছে কিনা অথবা রুগী ত্রটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিন জিন বহন করছে কিনা

প্রশ্ন.৭. গর্ভস্থ সন্তানের থ্যালাসেমিয়া আছে কিনা তা জানার জন্য কোন পরীক্ষাগুলো করা হয়?
উত্তর. এক্ষেত্রে যে পরীক্ষা গুলো করা হয় সেগুলো হলো:
§  কোরিওনিক ভিলিয়াস স্যাম্পলিং (Chorionic villus sampling)
§  এ্যামনিওসেনটিসিস (Amniocentesis)
§  ফিটাল ব্লাড স্যাম্পলিং (Fetal blood sampling)

এ বিষয়ে এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২৭৩২তম পর্বে কথা বলেছেন ডা. মুজাহিদা রহমান। বর্তমানে তিনি অ্যাপোলো হাসপাতালের হেমাটোলজি বিভাগের বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত।
প্রশ্ন : থ্যালাসেমিয়ার রোগীদের খাবারদাবারে কোনো বিষয় আছে কী?
উত্তর : যেহেতু এরা নিয়মিত রক্ত নিয়ে বেঁচে থাকে, দেখা যায় একদিকে যেমন রক্ত নিচ্ছে, অন্য দিকে দেহে লৌহ বা আয়রন জমা হচ্ছে। লৌহ বা আয়রন জমে অঙ্গগুলো ক্ষতিগ্রস্ত করে ফেলে। ডায়াবেটিসহার্ট ফেইলিউর ইত্যাদি হতে পারে।
প্রশ্ন : কোন কোন খাবার খেতে নিষেধ করা হয়?
উত্তর : আমরা আয়রন তাদের জন্য মানা করে দেই। সাধারণত আয়রন জাতীয় জিনিস তারা খেতে পারে না।

থ্যালাসেমিয়া এটি একটি জিনগত রোগ, তবে এই রোগকে প্রতিরোধ করা সম্ভব। যদিও এই রোগের চিকিৎসা বেশ ব্যয়বহুল। এই রোগ থেকে রেহাই পেতে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন করতে হয়।
প্রশ্ন : থ্যালাসেমিয়া নামটি অনেকেই এখন জানে। অনেকেই এ রোগে আক্রান্ত হয়। এ রোগ হয় কেন এবং এর কারণ কী?
উত্তর : থ্যালাসেমিয়া কোনো পরিবেশ দ্বারা বা জীবাণু দ্বারা হয়, বিষয়টি তা নয়। এটি একটি বংশগত রোগ। এটি জন্মগত বা বংশগত রক্তস্বল্পতাজনিত রোগ। একটি শিশুর দৈহিক গঠন থেকে শুরু করে সবকিছু জিনগতভাবে নিয়ন্ত্রিত। তার বাবা-মায়ের গুণাবলি তার ভেতরে সঞ্চারিত হয়। ঠিক একইভাবে তার ভেতরে যে রক্ত সঞ্চারিত হয়, সেটাও নির্ভর করে তার বাবা ও মায়ের রক্তের গঠন কেমন হবে, তার ওপর। বিশেষ করে রক্তের যে হিমোগ্লোবিন, সেটা পরিবর্তন হয় আলফা ও বেটা দুটো চেইনের মাধ্যমে। এই চেইনের মধ্যে যদি জন্মগত ত্রুটি বাবা-মায়ের মধ্যে থাকে, চেইন যদি দুর্বল হয়, যে পরিমাণ চেইন তৈরি হওয়ার কথা সে পরিমাণ না থাকে, জিনগত কোনো সমস্যার কারণে এ সমস্যা হতে পারে। এটা বাবা-মায়ের মধ্যে থাকলে সন্তানের ভেতর সঞ্চারিত হয়। তাহলে একজন বাবা ও মা তাঁর ভেতরে যদি থ্যালাসেমিয়ার কোনো জিন (অর্থাৎ হিমোগ্লোবিন তৈরির যে সমস্যা সেটা যদি থাকে, তাহলে বাচ্চার ভেতর এটা সঞ্চারিত হবে) থাকে, বাচ্চা তখন এই রোগের বাহক বা এই রোগে আক্রান্ত হবে। যদি বাবা ও মায়ের মধ্যে শুধু একজনের কাছ থেকে এসে থাকে, একে বলব থ্যালাসেমিয়া মাইনর। আর যদি উভয়ের কাছ থেকে এসে থাকে, তখন জটিল আকার ধারণ করতে পারে। অথবা মাঝামাঝি অবস্থান ধারণ করতে পারে। সে ক্ষেত্রে আমরা একে বলব থ্যালাসেমিয়া মেজর। 
প্রশ্ন : এই মাইনর ও মেজরের বিষয়টি কী? অনেক সময় রক্তে জিনগত কারণে সমস্যা বা বেটা চেইনের সমস্যা হলেও রোগটি প্রকাশ পাচ্ছে না। আবার অনেকের ক্ষেত্রে প্রকাশ পাচ্ছে। এর কারণগুলো কী?
উত্তর : বিষয়টি হলো বাবা ও মা উভয়ের ক্ষেত্রে যদি কোনো জেনেটিক সমস্যা থাকে এবং উভয়ের কাছ থেকে যদি থ্যালাসেমিয়ার জিন নিয়ে আসে, বংশপরম্পরায় যদি তার মধ্যে ধারণ করে নিয়ে আসে, তাহলে দেখা যাবে তার হিমোগ্লোবিন তৈরির বিষয়টি একেবারে সংকুচিত হয়ে আসছে। সে ক্ষেত্রে তার জন্মের পর থেকেই বিষয়গুলো শুরু হয় এবং রক্তশূন্যতা হয়। আবার যদি বাবা ও মায়ের মধ্য থেকে যেকোনো একজন থেকে একটা সমস্যাগ্রস্ত জিন যদি বাচ্চার ভেতর সঞ্চালিত হয়, তাহলে (এখানে মনে রাখতে হবে বাবার থেকে একটা জিন এবং মায়ের থেকে একটা জিন, এই এক জোড়া জিন দিয়ে সন্তান তৈরি হয়।) এর মধ্যে একটা জিন যদি সমস্যাগ্রস্ত হয় মা অথবা বাবার কাছ থেকে, তাহলে তার আরেকটি জিন কিন্তু ভালো আছে, ওই সক্রিয় জিন দিয়ে মোটামুটি সে চলনসই হয়ে যায়। মধ্য বয়স পর্যন্ত তার কোনো সমস্যা হয় না। এদের কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, মধ্য বয়সে গিয়ে রক্তের স্বল্পতা দেখা দেয়।

প্রশ্ন : কী লক্ষণ দেখলে বোঝা যাবে, বাচ্চাদের থ্যালাসেমিয়া আছে কি না?
উত্তর : যার এই থ্যালাসেমিয়া মেজর, অর্থাৎ যে বাবা ও মা উভয়ের কাছ থেকে তার এই সমস্যাগ্রস্ত জিন জন্মগতভাবে পেয়েছে, তার জন্মের পরপরই দেখা যাবে সে ফ্যাকাসে। আর বাচ্চার যে স্বাভাবিক বৃদ্ধিগুলো হয়, সেগুলো ধীরে ধীরে হচ্ছে। অর্থাৎ তার হাঁটা, দাঁড়ানোর সময়, বসার সব মাইলস্টোনই ধীরগতির হয়ে যায়। অন্য একটা সাধারণ বাচ্চার সঙ্গে যদি তুলনা করি, তার বৃদ্ধিটা ধীরে হয়। একটা ১০ বছরের স্বাভাবিক বাচ্চার যেমন বাড়ন্ত হবে আর থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত বাচ্চাকে দেখতে মনে হবে পাঁচ বছর। এই ফ্যাকাসে মানে হলো তার রক্তস্বল্পতা। তার শক্তি পাচ্ছে না, তার ক্ষুধামন্দা, কোনো কিছুতে সে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এই সঙ্গে শারীরিক কিছু বৈশিষ্ট্য দেখতে পাব। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, সে বিদেশিদের মতো সাদা। এ ছাড়া তার দুই চোখের দূরত্বটা বেড়ে যায়। নাকের গোড়া প্রসারিত হয়ে যায়। বড় হলে দেখা যাবে দাঁত হয়তো ফাঁক হয়ে আছে। কপালের সামনে যে হাড় আছে, সেটা ফুলে যায়। সবকিছু মিলে তাকে বলা হয় থ্যালাসেমিক ফেসি। অর্থাৎ একটা আদিবাসী ভাব তার মধ্যে দেখা যায়। চোখ অনেকটা হলুদ। হাতের দিকে তাকালেও মনে হবে হলুদ। এর পর যদি তার পেটের দিকে তাকাই দেখা যাবে পেটটা বেশ ফুলে আছে।
আমরা যদি পরীক্ষা করি দেখা যাবে তার প্লিহা। এটা বাঁ দিকে খাঁচার নিচে থাকে। এই প্লিহা প্রথমে বড় হয়, এর পর লিভার আস্তে আস্তে বড় হয়। এই অঙ্গগুলো যখন বড় হয়ে যায়, তখন তার খুব ঘন ঘন রক্ত দিতে হয়। এই রক্ত না দিলে সে স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারে না। এই লক্ষণগুলো দেখলে বাবা-মা বুঝবেন তার স্বাভাবিক গতি বৃদ্ধি করছে না। 

প্রশ্ন : থ্যালাসেমিয়া রোগের কি কোনো চিকিৎসা আছে, সেটা কি নিরাময়যোগ্য?
উত্তর : থ্যালাসেমিয়া নিরাময়যোগ্য। তবে যেহেতু এটি একটি জন্মগত সমস্যা, যদি তার জিনগত সমস্যাকে পরিবর্তন করা না হয়, অর্থাৎ যে অঙ্গ দিয়ে সমস্যাযুক্ত হিমোগ্লোবিন তৈরি হচ্ছে, সে অঙ্গ মানে বোনমেরু (অস্থিমজ্জা), এটাকে যদি অস্থিমজ্জা সংযোজনের মাধ্যমে পরিবর্তন করা যায়, তাহলে একে সম্পূর্ণ নিরাময় করা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে একজন ম্যাচ ডোনার লাগবে। এবং এটা দেশের বাইরে গিয়ে করতে হবে। কারণ, আমাদের দেশে এটা এখনো চালু হয়নি। আর যাঁরা বোনমেরু ট্রান্সপ্লান্ট করতে পারছেন না, তাঁদের নিয়মিত রক্ত দিয়ে জীবন সচল রাখতে হবে। তবে এই রক্ত দিতে দিতে তাঁর শরীরে সমস্যা তৈরি হয়, আয়রন জমে যেতে পারে। এই আয়রন জমে গিয়ে হার্টের সমস্যা, হরমোনের সমস্যা, লিভার, কিডনি, মস্তিষ্কের সমস্যা এ ধরনের অনেক সমস্যা হয়। তাই একজন চিকিৎসকের তত্ত্বাবধায়নে থেকে রক্ত দিতে হবে এবং জটিলতাগুলোরও চিকিৎসা করতে হবে।
বর্তমানে ভয়াবহ এবং ব্যায়বহুল রোগগুলোর মধ্যে একটি থ্যালাসেমিয়া রোগ। যা মানুষের মৃত্যুর কারণও হতে পারে। এটি সাধারণত একটি বংশগত রোগ, যাতে রক্তে হিমোগ্লোবিন এর পরিমাণ কমে যায়। রোগীকে বাচিয়ে রাখতে আজীবন রক্ত দিয়ে যেতে হয়। পরিবার কে যেতে হয় সীমাহীন আর্থিক ও মানসিক দুর্দশার মাঝ
দিয়ে।
a2.jpg

থ্যালাসেমিয়ার ভয়াবহতাঃ
থ্যালাসেমিয়ার রোগীকে বাঁচিয়ে রাখতে দিনের পর দিন রক্ত দিয়ে যেতে হয়। প্রতি ব্যাগ রক্তের সঙ্গে জমা হচ্ছে ২০০ মিলিগ্রাম করে আয়রন। এই আয়রন আস্তে আস্তে লিভার প্যানক্রিয়াসের প্রতিটি কোষ ধ্বংস করে দেয়। ফলে ডায়াবেটিস, সিরোসিস রোগের উত্পত্তি হয়। উপরন্তু পানিবাহিত রোগের মতো নানা রক্তবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়; যেমন
জন্ডিস, এইচআইভি, হেপাটাইটিস বি সি ভাইরাসজনিত রোগ। এই আয়রন নিয়ন্ত্রনের জন্য প্রয়োজন হয় ব্যয়বহুল ঔষধ। থ্যালাসেমিয়ার রোগীর জীবনকাল ২০-৩০ বছর পর্যন্ত। এই স্বল্পকালীন জীবনে রোগীর নিজের ও পরিবারের যে মানসিক অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটে তা কেবল ভুক্তভোগী ছাড়া কারো পক্ষে অনুধাবন করা সম্ভব নয়।


প্রয়োজন একটু সচতনতাঃ
আপনি হয়ত জানেনই না যে নিজের অজান্তেই বহন করে চলেছেন এই জিনটি, যেটা আপনার জন্য হয়ত ক্ষতিকর কিছু নয় কিন্তু আপনার একটু অসচেতনতাই আপনার ভবিষ্যতের ঘুম হারাম করে দিতে পারে। জীবনকে করে তুলতে পারে দুর্বিসহ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে থ্যালাসেমিয়া ক্যারিয়ারের সংখ্যা এক কোটি ২০ লাখ। সচেতনার অভাবে দুর্ভাগ্যক্রমে এদের শতকরা ৫ ভাগও যদি পরস্পরের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়, তাহলে ভবিষ্যতটা একবার চিন্তা করুন!
অ্যাফেয়ার ম্যারেজ কিংবা পারিবারিকভাবে সেটেল্ড- যেভাবেই হোক, একজন সচেতন মানুষ হিসেবে বিয়ের আগে এই টেস্টটি করে জেনে নিন আপনারা দুজনেই ক্যারিয়ার কিনা। যে কোন একজন ক্যারিয়ার হলে সমস্যা নেই, তবে দুজনে ক্যারিয়ার হলে সম্পর্ক স্থাপনে বিরত থাকুন। একমাত্র দুজন থ্যালাসেমিয়ার ক্যারিয়ারের পরস্পরের সাথে বিবাহ রোধই বাঁচাতে পারে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রাণঘাতী এই রোগটি থেকে।

নিজের ভবিষ্যৎ, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে থ্যালাসেমিয়া রোগী হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করুণ। মনে রাখবেন, পরিবারে একটি থ্যালাসেমিয়া রোগীর জন্ম হওয়া মানে সারাজীবনের জন্য ওই পরিবারের সুখ-শান্তি শেষ হয়ে যাওয়া।

থ্যালাসেমিয়া চিকিৎসা ব্যবস্থা অপ্রতুল। তবে চিকিৎসার জন্য একজন রক্তরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন। অনেক ক্ষেত্রে ঘন ঘন ব্লাড ট্রান্সফিউশন ও আয়রন চিলেশনের (Iron Chelation) প্রয়োজন হয়। কিউরেটিভ চিকিৎসা হিসাবে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন (BMT) লাভজনক এবং জীন থেরাপি প্রয়োগের চেষ্টা চলছে। তবে রোগের বিস্তার রোধের (Prevention) দিকে অধিক মনযোগী হওয়া প্রয়োজন। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৬-৭% লোক এ রোগের কেরিয়ার/বাহক এবং ভবিষ্যতে তা আরও বৃদ্ধি পাবে যদি না আমরা সতর্ক হই।

Post a Comment

If you learn something from our post please comment...

 
Top