0
জেনে নিন বনসাই গাছের ইতিবৃত্ত


বনসাই কি 

বনসাই অর্থ ট্রের মধ্যে ফলানো। শক্ত কান্ড রয়েছে এমন গাছের খর্বাকৃতি করার শিল্পকে বনসাই বলা হয়। বনসাই তৈরীতে নান্দনিকতার ছোঁয়া থাকে।

শব্দের উৎপত্তি

বনসাই শব্দটি জাপানী; চীনা পেনজাই শব্দ থেকে বনসাই শব্দের উৎপত্তি হয়েছে।

বনসাই এর ইতিহাস

 প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় পাত্রে/ টবে গাছের বিভিন্ন ধরনের চারা জন্মানোর কথা জানা যায়। ৪০০০ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দে পাত্রে গাছ লাগানো হত। এরকম তথ্য সে সময়কার রাজনৈতিক নথিপত্র ঘেটে জানা যায়। ঐ সময়ে পাথর কেটে পাত্র তৈরী করে সে পাত্রে গাছ লাগানো হত। তৃতীয় ফারাও রামেসেস পাত্রে বিভিন্ন ধরনের গাছ লাগিয়ে অনেক মন্দিরে দান করেছিলেন। প্রাচীন কালে ভারতে টবে পাত্রে বিভিন্ন ধরনের গাছ লাগানোর প্রচলন ছিল। সে সময়ে ঔষধ ও খাবারের জন্য পাত্রে গাছ লাগানো হত। এক হাজার বছর আগে চীনে এর প্রচলন শুরু হলেও দ্বাদশ শতাব্দীতে জাপানীদের নান্দনিক ছোঁয়ায় এটি শিল্পে পরিণত হয়।

বনসাইয়ের ধরণ 

  •  ব্রুম: এ জাতীয় বনসাই দেখতে অনেকটা ছাতার মতো দেখায় ফরমাল এ জাতীয় বনসাইয়ের ডালপালা গুলোর নিয়মিত শয্যা বিন্যাস হয়ে থাকে। 
  • ইনফরমাল - ডালপালাগুলোর শয্যা বিন্যাস নিয়মিত হতে দেখা যায় না। ডালপালা এলোমেলো হয়। 
  • রুট ওভার রক-  টবের পাথরের উপরে বৃক্ষ মূলের সৌন্দর্য প্রকাশিত হয় রুটওভার রক এর ক্ষেত্রে। 
  • রুট অ্যাক্সপোজ এ জাতীয় বনসাইয়ের শিকড়গুলো টবের মাটির উপর ছড়িয়ে থাকে। ছড়িয়ে থাকা শিকড়গুলো এই বনসাই এর সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয়। 
  • ইনফরমাল আব্রাইট এ বনসাই গুলো দেখতে ইনফরমাল বনসাইয়ের মত টুইন ট্রাংক এ জাতীয় বনসাইয়ের গাছে দুটি কান্ড থাকে ট্রিপল ট্রাংক এ জাতীয় বনসাইয়ের গাছে ৩ টি কান্ড থাকে মাল্টিট্রাংক তিনের বেশি কান্ড থাকলে সে বনসাইকে মাল্টিট্রাংক বনসাই বলে 
  • স্পান্টিং বনসাইয়ের গাছ একদিকে হেলে থাকলে সেটাকে স্পান্টিং বলে কাসকেড এই ধরনের বনসাইয়ের গাছগুলো টবের সীমানা ছাড়িয়ে ঝর্নার মতো নিচের দিকে গড়িয়ে নামে। 

বনসাইয়ের আকার 

  •  বনসাই সাইজ ছোট বনসাই ১০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত 
  • মধ্যম বনসাই ১০ সেন্টিমিটার থেকে ২৫ সেন্টিমিটার 
  • বড় বনসাই ২৫ সেন্টিমিন্টার থকে ৪৫ সেন্টিমিটার 

ভালো বনসাই 

 ভালো বনসাই গাছে সামনের চেয়ে পেছনে পাতা থাকতে হয়। গাছের প্রধান কান্ডটিকে সবচেয়ে বেশি মোটা থাকতে হয়। গাছের উচ্চতানুযায়ী গাছের শাখা প্রশাখা অর্ধেক বা তার চেয়ে বেশি থাকতে হয়। নিচের দিকের প্রথম ডালটি সবচেয়ে মোটা হতে হয়। গাছের বাইরের আকৃতি দেখতে অনেকটা ত্রিভুজের বৃত্তের মত দেখাতে হয়। মরে যাওয়া এবং রুগ্ন পাতা, পোকা-মাকড় থাকবে না। টবের রং গাছের সাথে মানানসাই হতে হয়। বনসাইয়ের পাত্রে/ টব পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন হতে হয়। গাছের সব পাতার আকার এরকম হতে হয়। ফুল ও ফলে কোন ধরনের বিকৃতি থাকতে পারে না। বনসাইয়ের প্রশিক্ষণ বনসাই তৈরীর প্রশিক্ষণ নিলে চাইলে নিচের ঠিকানায় যোগাযোগ করা যেতে পারে। বাংলাদেশ বনসাই সোসাইটি ফোন: ০২- ৮১২২৬৮৬ মোবাইল: ০১৭১১-৮১০২৬২, ০১৭১১-৪২০১২২, ০১৭১১-৮২৬৫৩৩ 

বনসাই উপযুক্ত গাছগুলো 

যে সকল গাছের বৃদ্ধি ধীরে ধীরে হয়। গাছের কান্ড মোটা হয়। বছরে একবার পাতা ঝরে। গাছের বয়স হলে গাছের ছাল মোটা হয়। গাছের ঝুরি নামে এমন গাছ, শিকড় কেটে দিলে ঝুরি গাছের শিকড়ের কাজ করে। গাছ অনেকদিন সতেজ থাকে এবং গাছের বয়স অনুযায়ী বেঁচে থাকে। যেখানে বা যেদেশে বনসাই করা হবে সে স্থানের আবহাওয়া উপযোগী হতে হয়। বাংলাদেশে বনসাই করা যেতে পারে 

এমন গাছগুলো হল 

বট, বকুল, শিমুল, পাকুড়, তেতুল, শিবীষ, বাবলা, পলাশ, বিলিতি বেল, ছাতিম, হিজল, জাম, নিম, বেলি, গাব, শেফালী, পেয়ারা, হেওরা, ডালিম, তমাল,জাম্বুরা, কমলা, তুলশী, বহেরা, বরই, বর্ডার, কামিনী, বগুন, মেহেদী, কড়ই, অর্জুন, জারুল, জুনিপার, নরশিংধ, করমচা, লুকলুকি, কৃষ্ণচূড়া, কদবেল, দেবদারু, সাইকেশ, হরিতকি, কামরাঙা, আমলকি, নীলজবা, লালজবা, কুসুমফুল, এশফেরা, ধানপাতা, অশ্বথ বট, নুডা বট, পাকুর বট, কাঠলি বট, রঙ্গন ছোট, রঙ্গন বড়, নিম সুন্দরী, লাল গোলাপ, খই বাবলা, কনকচাঁপা, গোলাপজাম, পাথরকুচি, সাদা নয়নতারা, স্টার কুইন, বাগান বিলাস, হেলিকুনিয়া, লাল টাইমফুল, গোলাপিটা ফুল, ক্যাকটাস গোল, ক্যাকটাস লম্বা, পান বিলাস, লালা পাতাবাহার, লাল জামরুল, চায়না বাঁশ, সন্ধ্যা মালতী হলুদ, যজ্ঞ ডুমুর, আলমন্ডা, এলাচি ও ঢেড়শ। 

বনসাই তৈরী করতে চাইলে

 বনসাই করার আগে যে গাছ নির্বাচন করা হয় সে গাছের বৈশিষ্ট্য ও অন্যান্য সম্পর্কে জেনে নিলে তা পরবর্তীতে সাহা্য্য করে। বনসাই গাছ বর্ষা ঋতুতে লাগানো উচিত। বনসাইয়ের উচ্চতা ৩-৫ ফুট পর্যন্ত হয়। বনসাই গাছকে প্রয়োজন মত খাদ্য দিতে হয়। বনসাই গাছে কালো মাটি, সরষে, নীমের খোল, ইটের চূর্ন, বালি খাবার হিসাবে কাজ করে। শীতের সময়ে একদিন অন্তর অন্তর গাছে পানি দিতে হয়। অপ্রয়োজনে গাছকে না ছোঁয়াই ভালো। শান্ত নিরিবিলি পরিবেশে গাছ রাখতে হয়। 

যে জায়গা উপযুক্ত 

 পানি নিষ্কাশন সুবিধা রয়েছে এবং সূর্যের আলো পৌঁছে এমন জায়গা বেছে নিতে হয় বনসাইয়ের জন্য। অর্থাৎ পরিবেশটা অবশ্যই খোলামেলা হতে হয। দোঁ-আশ ও বেলে মাটি বনসাইয়ের জন্য উপযুক্ত। কয়টি গাছের বনসাই করা হবে তার উপর জায়গার পরিমাণ নির্ভর করে। পাখি থেকে বনসাইয়ের কুড়ি বাঁচাতে নেট ব্যবহার করতে হয়। 

যে যন্ত্রগুলি প্রয়োজন 

  •  পট/ টব (বনসাই রোপনের জন্য) 
  • সিকেচার (ডাল কাটার জন্য) 
  • কাঁচি (পাতা কাটার জন্য) 
  • কনকেভ কাটার (ডালের গোড়া সরাতে) 
  • ওয়্যার কাটার (তার কাটতে) 

টব নির্বাচন 

  •  বনসাই উঁচু না হলে ছোট বাটির টব বাছাই করাই ভালো। 
  • টব বনসাইয়ের শাখা, প্রশাখার বিস্তারের চেয়ে ছোট হলে ভালো হয় এবং এতে বনসাইয়ের সৌন্দর্য বেড়ে যায়। 
  • টব যে কোন আকৃতির হতে পারে। রুচি অনুযায়ী ত্রিভুজাকার, বৃত্তাকার, আয়তাকার যেকোন আকৃতির বাছাই করা যেতে পারে। 

বনসাইয়ের চারা তৈরী 

  •  বনসাইয়ের চারা নার্সারী থেকে সংগ্রহ করা যায়। এছাড়া বীজ সংগ্রহ করেও চারা তৈরী করে নেওয়া যায়। 
  • যে সকল গাছের বীজ পাওয়া যায় না সে সকল গাছের চারা পেতে অঙ্গজ পদ্ধতি অবলম্বন করা যায়। 
  • কাটিং, তেউড় বিভাজন, দাবা কলম, ঝড় বিভাজন দাবা কলম, চোখ কলম, ঝুটি কলম ও অন্যান্য অংগজ পদ্ধতি অনুসরণ করে চারা তৈরী করে নেওয়া যায়। 
  • চারা তৈরী হয়ে গেলে টব/ পটে বনসাই রোপন করতে মাটি তৈরী করে নিতে হয়। 

মাটি তৈরী 

 বিভিন্ন জাতের বনসাইয়ের জন্য আলাদা ভাবে মাটি তৈরী করতে হয়। মাটি তৈরীতে জৈব সার ও দো-আঁশ বা পলি মাটি ব্যবহার করতে হয়। জৈবসার ও দো-আঁশ মাটির মিশ্রনে জৈব সারের পরিমাণ বেশী থাকতে হয়। 

একনজরে মাটি তৈরী

  •  দো-আঁশ মাটি পরিমান মতো কাঠের ছাই ৭৫ গ্রাম 
  • ইট গুড়ো ১৩০ গ্রাম 
  • খড়ি মাটির গুড়ো ৫০ গ্রাম 
  • হাড় গুড়ো ৫০ গ্রাম 
  • কম্পোস্ট ১/২ কেজি 
  • শুকনো গোবর পরিমাণ মতো 
  • পঁচা গোবর পরিমাণ মতো 
  • মোটা বালু অল্প পরিমাণ 
মাটি তৈরী করা হয়ে গেলে এরপর টবে চারা লাগাতে হয়। 

টবে চারা লাগানো 

 টবে মাটি রাখার আগে টবের পানি নিষ্কাশনের ছিদ্রের উপর এক টুকরা তারের জালি দিতে হয়। তারের জালির উপর কিছু কাঁকর দিয়ে ঢেকে দিতে হয়। এর পর তৈরী করা মাটি টবে রেখে চারা লাগাতে হয়। চারা লাগানো হয়ে গেলে চারার পাতা বড় হতে সময় দিতে হয়। 

পাতা কেটে দিতে হয় 

  •  পাতা বড় হয়ে হলে বছরে ২/১ বার পাতার বোঁটা রেখে বাকিটুকু ফেলে দিতে হয়। 
  • অন্তত দুটি বড় পাতা রেখে অন্য পাতাগুলো ফেলে দিতে হয়। 
  • নতুন পাতা গজাতে থাকলে বাকি বড় পাতাগুলো ফেলে দিতে হয়। 

ডাল কেটে দিতে হয় 

  •  প্রথমে ঠিক করে নিতে হয় যে গাছের কোন কোন ডালগুলো রাখা হবে। 
  • তবে ডালগুলো ঠিক জায়গায় রাখতে বনসাইয়ের সৌন্দর্যটাও মাথায় রাখতে হয় কারণ ডালের উপরই বনসাইয়ের মডেল নির্ভর করে। 
  • বনসাইয়ের কান্ডের শাখা সামনের দিকে না রেখে ডানে, বামে ও পেছনে রাখতে হয়। 
  • সরু ডাল কাটতে সিকেচার ও মোটা ডাল কাটতে করাত ব্যবহার করতে হয়। 
  • ডাল কাটা হলে ডালের কাটা স্থানে কাটিং পেস্ট দিয়ে ঢেকে দিতে হয়। 

তার বাঁধতে হয় যেভাবে 

  •  গাছের কান্ডের জন্য মোটা তার ও শাখার জন্য সরু তার ব্যবহার করতে হয়। 
  • তারগুলো তামার অথবা গ্যালভানাইজিংয়ের তারও হতে পারে। ৪৫ ডিগ্রী কোনে তারগুলো পৌঁচাতে হয়। 
  • মোটা কান্ডে তার পেঁচানোর আগে কাপড় পেঁচিয়ে নিতে হয়। 
  • তার বেশি ঘন করে ফাঁকা বেশি না রেখে পেঁচানো ভালো। 
  • তার পেঁচালে গাছ দূর্বল হয়ে যায়। তার খোলার পর সরাসরি সূর্যের আলো পৌঁছে না এমন জায়গায় ৭ দিনের জন্য রাখতে হয়। 
  • ছয় মাস অন্তর অন্তর গাছে তার জড়াতে হয়। 

বনসাইয়ের পরিচর্যার নিয়ম সমূহ 


  • গাছকে নিয়মিত খাবার দিন। যেমন, কালো মাটি, বালু বা ইটের চূর্ণ, সরিষা বা নীলের খোসা ইত্যাদি। 
  • বনসাই অতিরিক্ত পানিবদ্ধতা এবং রোদ— কোনোটাই সহ্য করতে পারে না। তাই এ বিষয়ে খেয়াল রাখুন। 
  • বনসাই ধুলা-ময়লামুক্ত রাখতে পানি দিয়ে পাতা ও ডাল মুছে দিন। 
  • টবের মাটিতে পোকামাকড় কিংবা ছত্রাকের প্রাদুর্ভাব হলে সঠিক মাত্রায় ওষুধ প্রয়োগ করুন। 
  • এমন স্থানে রাখুন, যেখানে আলো-বাতাস চলাচল করে কিন্তু লোকজনের যাওয়া-আসা কম। 
  • নির্ধারিত আকৃতি ঠিক রাখতে নির্ধারিত ডালপালা বাদে ছাঁটাই করুন। 
  • বেশি ব্যস্ত থাকলে সঠিক মাত্রায় তরল বা স্পেস সার প্রয়োগ করতে পারেন। 
  • অবশ্যই প্রতি এক বছর অন্তর টবের মাটি পরিবর্তন করুন। 
  • গাছের ছাঁটাইসহ অন্যান্য কাজে বনসাই পরিচর্যার জন্য নির্ধারিত যন্ত্রপাতি ব্যবহার করুন। 
  •  আপনার বনসাইটি কোনো কারণে বনসাইটি বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলে, যেখান থেকে কিনেছেন, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
  • ব্যক্তিগতভাবে বনসাই সংগ্রহ করেন এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলুন।

একটু আন্তরিকতাপূর্ণ দেখভাল আপনার বনসাইটিকে আরও সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। এ ক্ষেত্রে খুব বেশি ঝামেলার দরকার হয় না।

Post a Comment

If you learn something from our post please comment...

 
Top