0

২০০৯ এর জুন এর দিকে। বর্ষা আসবে আসবে ঠিক এমন একটা সময়।নতুন ক্যাম্পাসে নতুন সেমিষ্টার শুরু। সেমিষ্টার শুরু বলে পড়ার চাপ ও নেই বললেই চলে, তার উপর আবার নতুন ক্যাম্পাস। অদ্ভুত সুন্দর একটা ক্যাম্পাস। ক্যাম্পাসেই থাকতে ইচ্ছে করে সারাদিন। তো আমার মত ছেলে যে কিনা ক্লাস শেষ হলেই দৌড়, সেও এখন ক্যাম্পাসে বন্ধুদের সাথে অনেক আড্ডাবাজিতে মেতে থাকে। প্রিয় জায়গা সাউথ একাডেমিক ভবনের সপ্তম তলা। সত্যি বলছি,আমি ঢাকা শহরের আকাশ এর চেয়ে সুন্দর অন্য কোথাও থেকে দেখিনি।     

প্রবল রোদ কিংবা অঝড় বৃষ্টি, আলাদা করে শুধুসুন্দর আকাশটা দেখা- পার্থক্যটা শুধু ভিন্নভিন্ন সৌন্দর্যে। আমি তো ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট এর ছাত্রআর গল্পের নায়িকা ইংরেজী ডিপার্টমেন্টের। ­গল্পের শুরু ক্লাস রুম এ। ইউনিভার্সিটিতেএই ভিন্ন ডিসিপ্লিনের ছাত্রছাত্রীরা এক ই ক্লাস রুমে আসে শুধু জিসিই(জ়েনারেল এন্ড কন্টিনিউইং এডুকেশ্ন) বিভাগের ক্লাস করতে। সৌভাগ্যবশত, আমারা দুজনেই একই জিসিই সাবজ়েক্ট এ রেজিস্ট্রেশন করেছিলাম। সেই সাবজ়েক্ট এর আবার ২টাসেকশন ছিল। যেদিন আমারপ্রথম ক্লাস ছিল সেদিনআমি ওকে ক্লাস এ দেখিনি। সে অন্য সেকশনে ছিল। ওই সেকশনেওর কোন বন্ধু ছিলনা। তাই ও স্যার কে বলে আমাদের সেকশনে চলে এল এবং দ্বিতীয় দিন থেকেএখানেই ক্লাস করা শুরুকরল। “Love at 1st sight” হয়ত একেই বলে, কখনো ধারনা ছিলনা। ক্লাসে ঢুকার সাথে সাথেই ওকে চোখে পড়ল এবং সারাটা পিরিয়ড বলতে গেলে ওর দিকেই তাকিয়ে কাটিয়েছিলাম।দু ­ একবার চোখাচোখিও হল, ও চোখ সরিয়ে নিল। 

জীবনেঅনেক কিছুই প্রথমবার হয়। বিশ্বাস করুন আর না ই করুন, এই জিনিস আমার সাথে যায়না। ভা্বলাম, ব্যাপারটা হয়ত কিছুই না; কেটে যাবে এই ভাললাগা। তারপরের দিন ও ক্লাস এএকি অবস্থা। হাস্যকর!নিজের উপর কোনকন্ট্রোল ই নাই আমার। আমার বন্ধু মারূফ ছিল আমার সাথে ওই ক্লাসে। সেদিন, ক্লাস শেষে ওকে বললাম সব।মারূফ তার চিরাচরিত হাসি হাসল আরবলল গিয়ে কথা বললেই পার। ইউনিভার্সিটিতে যার কখনও কোন মেয়ের সাথে হায়,হ্যলো ছাড়া একটা অতিরিক্ত কথা হয়নি সে গিয়ে বলবে তার ভাল লাগার কথা। 

এও কি সম্ভব, তাও সম্পূর্ন একটা অপরিচিতমেয়েকে!!! যে কোন কারনেই হোক,পরেরক্লাসটা আমার করা হয়নি। মারূফের ও ক্লাস করার কথা ছিল নাসেদিন। সেদিন মারূফ ক্লাস না করলে হয়ত আজকে লিখতেও পারতাম না!! স্যার সেদিন ক্লাসের সবার সেলফোনেরনম্বর আর ইমেইল আইডি নিয়েছিল। মারূফ নিজ থেকেই ওর নম্বর আর ইমেইল আইডি টুকে রেখেছিল। মজার বিষয় হচ্ছে, আমরা কেউই ওর নাম জানতাম না।ও আর ওরএকটা ফ্রেন্ড এক সাথে বসত সবসময়। তো মারুফের কাছে যখন লিস্টটা আসল নিজেরটা লিখার জন্য, ও ওদের সিটএরেঞ্জমেন্ট দেখে গুনাশুরু করল ওদের নাম কোথায় লিখা। হাস্যকর!!আমি এখনও এর উত্তর খুজি, মারূফ এটা কেন করল!! খুবই অবাক হলাম, পরদিন যখন মারুফ এগুলো আমাকে দিল। 

অনুভূতিটা কেমন ছিল বলে বুঝান সম্ভব না!! কিন্তু, তখনো আমি গল্পের নায়িকার নাম জানিনা। এতদিন ব্যাপারটা ভাল লাগাতেইসীমাবদ্ধ ছিল,কিন্তু এখন তার চেয়েও বেশি কিছু!! সেই বেশি কিছু কি তার সংগা আমি দিতে পারব না। ২ ২টা সেল নম্বর আর ইমেইল আইডি এখন আমার কাছে। কিন্তু কিভাবে বুঝব কোনটা কার?? ফোনওতো করা সম্ভব না। কি বলব?? হয়ত রেস্পন্সও করবে না। ভাবলাম যে, ফেইসবুক এ ২ টা আইডি দিয়ে সার্চ দেই। ১মটাদিয়ে সার্চ দেয়াতে কোন রেসাল্টই পেলাম না। মনটা খারাপ হয়ে গেল।ভাবলাম,২য়ট ­তেও যদি একই হয়!!যা ও একটুআশার আলো দেখলাম,তাও হয়ত শেষ। কিন্তু তা হল না। ২য় সার্চ রেসাল্টটা দেখে অনেকক্ষন হাসলাম!! বাবলি বারাকাত, স্বপ্নকন্যার নাম। তারপর তো ভাললাগা জমানো শুরু। আমি ওকে দেখতাম, মনে মনে অজানা ভবিষ্যৎ এর কিছু সুন্দর ছবি আঁকতাম। 

মাসখানেক পরের একদিন। সারাদিন বৃষ্টি হল। মিস করছিলাম ওকে খুব। কিন্তু কি করব? সন্ধায় ওকে একটা মেইলকরলাম “anonymous” হিসেবে,নতুন একটা মেইল আইডি থেকে।জানতে চেয়েছিলাম বৃষ্টি সম্পর্কে ওর অনুভূতি। খুব একটা আশা রাখিনি যে রেস্পন্স পাব। কিন্তু ২-৩ দিন পর পেলাম তাও।জানতে চাওয়া হয়েছে আমি কে???? আমি আর যাই বললাম, আমরা যে একসাথে ক্লাস করি তা বললাম না। এমন মেইল চালাচালিচলতে থাকল বেশ কিছুদিন;তারপর মেসেঞ্জার। নিজেদের নিয়ে অনেক কথা হত। ইউনিভার্সিটিতে আমি ওকে খুব ফলো করতাম। ওরআশেপাশে থাকলে খেয়াল করতাম ও কি করে, কি কথাবলে!!এবং এগুলো এসে ওকে মেইল করতাম। যেহেতু, ও আমাকে চিনে না, ব্যাপারটাতে আমি যতটাই মজা পেতে শুরু করলাম, ও ততটাই বিরক্ত এবং একই সাথে কৌতহলী। আস্তে আস্তে পড়াশোনারচাপ বাড়ল।আমার মেসেঞ্জারে যাওয়া কমল।অল্প একটু সময়ের জন্যও যখন ঢুকতাম, ও অনেক অভিমানমাখা সুরে বলত, “আর আসছেন কি করতে?”। ।আমি বুঝলাম, ও আমাকে মিস করা শুরু করেছে। আমাদের ফোনে কথা হত না। একদিন, আমার নম্বরের জন্য খুব ধরল।আমি প্রথমে দিতে চাইলাম না। পরে দিলাম।কিন্তু এমন একটা নম্বর দিলাম যেটা শুধুরাতেই খোলা থাকে। ও আমাকে সারাদিন চেষ্টা করত। পেত না!!! রাতে খুব রাগিরাগি গলায় বলত “নম্বরটা না দিলেই পারতেন”!!আমি দেখতে চাইতাম ওর ধৈর্য কেমন!! 

একটা পর্যায়ে এসে আমি নিজেই আর পারলাম না।কথা বলা শুরু হল অনেক। কথা হত নিজেদের স্বপ্ন, ভবিষ্যৎ আর ভাললাগা নিয়ে। নিজেদের অনুভুতিগুলো আমরা নিজেদের মধ্যে ভাগ করেনিতে থাকলাম। একদিন ও বলল দেখা করার কথা। আমি বললাম, তা তো করবই!! আমার মনে হছিল খুব সুন্দর এক্তা মুহুর্তের মধ্যে দিয়েযাচ্ছি। আরো কিছু সময়যদি আটকে রাখতে পারতাম। কিন্তু ও নাছোড়বান্দা। দুজন মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম, এই বর্ষায় এরপর যেদিন সকাল থেকেই ঝুম বৃষ্টি পড়বে,সেদিন দেখা করব। খুব বেশীদিন অপেক্ষা করতে হয়নি।তার ঠিক চারদিনের মাথায়, সকাল থেকে অঝোরে বৃষ্টি। ভাল লাগছিল। সেদিন আমার ক্লাস ছিল না। ও আমাকে এসএমএস করল “আজ কিন্তু আমাদের দেখা করার কথা!!”অনেক কষ্টে কাক ভেজা হয়ে ইউনিভার্সিটিতে পৌছালাম।ঠিক তখন ই আরেকটা এসএমএস। “সরি!!আমাকে এখুনি চলে যেতে হচ্ছে। আমার বড় খালামনি স্ট্রোক করেছে।” এসএমএস পড়ে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। 

সেলফোনটা অফ করে পকেটে রেখে দিলাম। জানি ওর অপারগতা, তারপরো খারাপ লাগল।বাইরে তখনো বৃষ্টি। ছেলেপেলে ভার্সিটির গেটে জটলা পাকিয়েছে। আমি দাড়িয়ে আছি। হঠাৎ পাশে ফিরে দেখি বাবলী সমানে সেলফোন টিপে যাচ্ছে।কাউকে হয়ত চেষ্টা করছে, পাচ্ছে না। চোখগুলো ছলছল করছে। আমি সাথে সাথে সেলফোন অন করলাম। আমিই সেই সৌভাগ্যবান। রিং রিং!!! হ্যালো বলতেই, বাবলী আমার দিকে তাকাল,আমিও তাকালাম। কতক্ষন দুজনই নিসচ্চুপ থাকলাম। ও দৃঢ় দৃষ্টি আর ধরা গলায় বলল, “এখনো কি নামটা বলবেন না!!” গল্পের পটভূমি বাংলাদেশে না হলে হয়ত একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরতাম। তারপর তো আস্তে আস্তে প্রণোয়াপাখ্যান ­। 

ও ই বলেছিল একদিন হঠাৎ করে খুব অনাকাংখিত একটা সময়ে। তারপর একসাথে রিকশা করে বৃষ্টি ভেজা,ফুচকা খাওয়া আর স্বপ্ন দেখা আজীবনের জন্য।পরের গল্পগুলো সাধারন কিন্তু নিজেদের মত। এখনো আমরা মান অভিমানের মুহুর্তগুলো জমা করে রাখি আমাদের মেইল বক্স এ। পুরনো সময়গুলো এখনো আমাদের কাছে ছবির মত।

Post a Comment

If you learn something from our post please comment...

 
Top