0
ইসলামের দৃষ্টিতে দেনমোহর

এতক্ষণ এমন এক স্বপ্নজগৎ ও আজব দেশের কথা বলছিলাম যেখানে ‘রাত্তিরেতে বেজায় রোদ, দিনে চাঁদের আলো।’ যে দেশে কিছু কিনতে গেলে ক্রীতবস্ত্তর বিনিময়ে কোন অর্থ দিতে হয় না; বরং বস্ত্তর সাথে ইচ্ছামত অর্থ পাওয়া যায়! এখন বাস্তব-জগতের কথায় আসা যাক।

বিবাহ এক দ্বিপাক্ষিক চুক্তি।  স্বামী-স্ত্রী উভয়েই একে অন্যের কাছে উপকৃত ও পরিতৃপ্ত। কিন্তু  স্বামীর অধিকার বেশী। তাই স্ত্রীর কর্তব্য অধিক। স্ত্রী তার দেহ-যৌবন সহ  স্বামীর বাড়িতে এসে বা সদা ছায়ার ন্যায়  স্বামী-পাশে থেকে তার অনুসরণ ও সেবা করে। তাই তো এই চুক্তিতে তাকে এমন কিছু পারিতোষিক প্রদান করতে হয় যাতে সে সন্তুষ্ট হয়ে  স্বামীর বন্ধনে আসতে রাজী হয়ে যায়। সৃষ্টিকর্তা সবয়ং মানুষকে এ বিধান দিয়েছেন। তিনি বলেন,

﴿وَالْمُحْصَنَاتُ مِنَ النِّسَاءِ إِلاَّ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ كِتَابَ اللهِ عَلَيْكُمْ وَأُحِلَّ لَكُمْ مَا وَرَاءَ ذَلِكُمْ أَنْ تَبْتَغُوا بِأَمْوَالِكُمْ مُحْصِنِينَ غَيْرَ مُسَافِحِينَ فَمَا اسْتَمْتَعْتُمْ بِهِ مِنْهُنَّ فَآتُوهُنَّ أُجُورَهُنَّ فَرِيضَةً﴾

‘‘উল্লেখিত (অবৈধ) নারীগণ ব্যতীত অন্যান্য নারীগণকে তোমাদের জন্য বৈধ করা হয়েছে, শর্ত এই যে, তোমরা তোমাদের সবীয় অর্থের বিনিময়ে তাদেরকে তলব করবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করার জন্য, ব্যভিচারের জন্য নয়। তাদের মধ্যে যাদেরকে তোমরা উপভোগ করবে তাদেরকে নির্ধারিত মোহর অর্পণ করবে।’’[1]

তিনি অন্যত্র বলেন,

﴿وَآتُوا النِّسَاءَ صَدُقَاتِهِنَّ نِحْلَةً﴾

‘‘এবং তোমরা নারীদেরকে তাদের মোহর সন্তুষ্টমনে দিয়ে দাও।’’[2]

আর প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন,

إِنَّ أَحَقَّ الشَّرْطِ أَنْ يُوفَى بِهِ مَا اسْتَحْلَلْتُمْ بِهِ الْفُرُوجَ.

‘‘সবচেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ শর্ত যা পূরণ করা জরুরী, তা হল সেই বস্ত্ত যার দ্বারা তোমরা (স্ত্রীদের) গুপ্তাঙ্গ হালাল করে থাক।’’[3]

সুতরাং স্ত্রীকে তার ঐ প্রদেয় মোহর প্রদান করা ফরয। জমি, জায়গা, অর্থ, অলঙ্কার, কাপড়-চোপড় ইত্যাদি মোহরে দেওয়া চলে। বরং প্রয়োজনে (পাত্রীপক্ষ রাজী হলে) কুরআন শিক্ষাদান, ইসলাম গ্রহণও মোহর হতে পারে।[4]

মোহর কম হওয়াই বাঞ্ছনীয়। তবে সেবচ্ছায় বেশী দেওয়া নিন্দনীয় নয়। মহানবী (সাঃ) তাঁর কোন স্ত্রী ও কন্যার মোহর ৪৮০ দিরহাম (১৪২৮ গ্রাম ওজনের রৌপ্যমুদ্রা) এর অধিক ছিল না।[5] হযরত ফাতেমা (রাঃ) এর মোহর ছিল একটি লৌহবর্ম।[6] হযরত আয়েশা বলেন, তাঁর মোহর ছিল ৫০০ দিরহাম (১৪৮৭,৫ গ্রাম ওজনের রৌপ্য মুদ্রা)।[7] তবে কেবল উম্মে হাবীবার মোহর ছিল ৪০০০ দিরহাম (১১৯০০ গ্রাম রৌপ্য মুদ্রা)। অবশ্য এই মোহর বাদশাহ নাজাশী মহানবী (সাঃ) এর তরফ থেকে আদায় করেছিলেন।[8]

তাছাড়া তিনি বলেন, ‘‘নারীর বর্কতের মধ্যে; তাকে পয়গাম দেওয়া সহজ হওয়া, তার মোহর সবল্প হওয়া এবং তার গর্ভাশয়ে সহজে সন্তান ধরা অন্যতম।’’[9]

হজরত মূসা (আঃ) তাঁর প্রদেয় মোহরের বিনিময়ে শবশুরের আট অথবা দশ বছর মজুরী করেছিলেন।[10]

মোহর হাল্কা হলে বিবাহ সহজসাধ্য হবে; এবং সেটাই বাঞ্ছিত। পক্ষান্তরে পণপ্রথার মত মোহর অতিরিক্ত বেশী চাওয়ার প্রথাও এক কুপ্রথা।

মোহরের অর্থ কেবলমাত্র স্ত্রীর প্রাপ্য হক; অভিভাবকের নয়। এতে বিবাহের পরে  স্বামীরও কোন অধিকার নেই। স্ত্রী বৈধভাবে যেখানে ইচ্ছা সেখানে খরচ করতে পারে।[11] অবশ্য স্ত্রী সন্তুষ্টচিত্তে সেবচ্ছায়  স্বামীকে দিলে তা উভয়ের জন্য বৈধ।[12]

স্ত্রীকে মোহর না দিয়ে বিবাহ করলে অনেকের নিকট বিবাহ বাতিল।[13]

আক্দের সময় মোহর নির্ধারিত না করলেও বিবাহ শুদ্ধ হয়ে যায়। কিন্তু  স্বামী-স্ত্রীর মিলনের পর স্ত্রী সেই মহিলার সমপরিমাণ চলতি মোহরের অধিকারিণী হবে, যে সর্বদিক দিয়ে তারই অনুরূপ। মিলনের পূর্বে  স্বামী মারা গেলেও ঐরূপ চলতি মোহর ও মীরাসের হকদার হবে।[14]

মোহর নির্দিষ্ট না করে বিবাহ হয়ে মিলনের পূর্বেই  স্বামী তালাক দিলে স্ত্রী মোহরের হকদার হয় না। তবে তাকে সাধ্যমত অর্থাদি খরচ-পত্র দেওয়া অবশ্য কর্তব্য।[15]

 বিবাহের সময় মোহর নির্ধারিত করে সম্পূর্ণ অথবা কিছু মোহর বাকী রাখা চলে। মিলনের পর স্ত্রী সে ঋণ মওকুফ করে দিতে পারে। নচেৎ ঋণ হয়ে তা  স্বামীর ঘাড়ে থেকেই যাবে।

মোহর নির্ধারিত করে বা কিছু আদায়ের পর বিবাহ হয়ে মিলনের পূর্বে  স্বামী মারা গেলেও স্ত্রী পূর্ণ মোহরের হকদার হবে। স্ত্রী মারা গেলে  স্বামী মোহর ফেরৎ পাবে না।[16]

মোহর নির্দিষ্ট করে আদায় দিয়ে মিলন করার পর  স্বামী স্ত্রীকে তালাক দিলে মোহর ফেরৎ পাবে না। মহান আল্লাহ বলেন,

﴿وَإِنْ أَرَدْتُمُ اسْتِبْدَالَ زَوْجٍ مَكَانَ زَوْجٍ وَآتَيْتُمْ إِحْدَاهُنَّ قِنْطَاراً فَلا تَأْخُذُوا مِنْهُ شَيْئاً أَتَأْخُذُونَهُ بُهْتَاناً وَإِثْماً مُبِيناً- وَكَيْفَ تَأْخُذُونَهُ وَقَدْ أَفْضَى بَعْضُكُمْ إِلَى بَعْضٍ وَأَخَذْنَ مِنْكُمْ مِيثَاقاً غَلِيظاً﴾

‘‘আর যদি এক স্ত্রীর স্থলে অন্য স্ত্রী গ্রহণ করা স্থির কর এবং তাদের একজনকে প্রচুর অর্থও দিয়ে থাক, তবুও তা থেকে কিছুই গ্রহণ করো না। তোমরা কি মিথ্যা অপবাদ এবং প্রকাশ্য পাপাচারণ দ্বারা তা গ্রহণ করবে? কিভাবে তোমরা তা গ্রহণ করবে, অথচ তোমরা পরস্পর সহবাস করেছ এবং তারা তোমাদের কাছ থেকে দৃঢ় প্রতিশ্রুতি নিয়েছে?’’[17]

মোহর ধার্য হয়ে আদায় না করে মিলনের পূর্বেই তালাক দিলে নির্দিষ্ট মোহরের অর্ধেক আদায় করতে হবে। অবশ্য যদি স্ত্রী অথবা যার হাতে বিবাহবন্ধন সে ( স্বামী) মাফ করে দেয়, তবে সে কথা ভিন্ন। তবে মাফ করে দেওয়াটাই আত্মসংযমের নিকটতর।[18]

মিলনের পূর্বে যদি স্ত্রী নিজের দোষে তালাক পায় অথবা খোলা তালাক নেয়, তবে মোহর তো পাবেই না এবং কোন খরচ-পত্রও না।[19] মোহর আদায় দিয়ে থাকলে মিলনের পরেও যদি স্ত্রী খোলা তালাক চায়, তাহলে  স্বামীকে তার ঐ প্রদত্ত মোহর ফেরৎ দিতে হবে।[20]

কোন অবৈধ বা অগম্যা নারীর সাথে ভুলক্রমে বিবাহ হয়ে মিলনের পর তার অবৈধতা (যেমন গর্ভ আছে বা দুধ বোন হয় ইত্যাদি) জানা গেলে ঐ স্ত্রী পূর্ণ মোহরের হকদার হবে। তবে তাদের মাঝে বিচ্ছেদ ওয়াজেব।[21]

একাধিক বিবাহের ক্ষেত্রে সকল স্ত্রীর মোহর সমান হওয়া জরুরী নয়।[22]

স্ত্রীর মোহরের অর্থ খরচ করে ফেলে  স্বামী যদি তার বিনিময়ে স্ত্রীকে তার সমপরিমাণ জমি বা জায়গা লিখে দেয় তবে তা বৈধ।[23] পক্ষান্তরে অন্যান্য ওয়ারেসীনরা রাজী না হলে কোন স্ত্রীর নামে (বা কোন ওয়ারেসের নামে) অতিরিক্ত কিছু জমি-জায়গা উইল করা বৈধ নয়। কারণ, কোন ওয়ারেসের জন্য অসিয়ত নেই।[24]

পাত্রীর নিকট থেকে ৫০ হাজার (পণ) নিয়ে ১০ বা ২০ হাজার তাকে মোহর দিলে অথবা নামে মাত্র মোহর বাঁধলে এবং আদায়ের নিয়ত না থাকলে অথবা দশ হাজারের দশ টাকা আদায় ও অবশিষ্ট বাকী রেখে আদায়ের নিয়ত না রাখলে; অর্থাৎ স্ত্রীর ঐ প্রাপ্য হক পূর্ণমাত্রায় আদায় দেওয়ার ইচ্ছা না থাকলে এই ধোঁকায় বিবাহ হবে কি না সন্দেহ। অবশ্য একাজ যে আল্লাহর ফরয আইনের বিরুদ্ধাচরণ তাতে কোন সঃন্দেহ নেই।

প্রকাশ যে, মোহর বিজোড় বাঁধা বা এতে কোন শুভলক্ষণ আছে মনে করা বিদআত।

﴿اتَّبِعُوا مَا أُنْزِلَ إِلَيْكُمْ مِنْ رَبِّكُمْ وَلاَ تَتَّبِعُوا مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ قَلِيلاً مَا تَذَكَّرُونَ﴾

(হে মানুষ!) ‘‘তোমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে যা অবতীর্ণ হয়েছে তোমরা তার অনুসরণ কর এবং তাঁকে ছাড়া ভিন্ন অভিভাবকদের অনুসরণ করো না। তোমরা খুব অল্পই উপদেশ গ্রহণ করে থাক।’’[25]

ফুটনোটঃ [1] (সূরা আল-বাক্বারা (৪) : ২৪)

[2] (সূরা আল-বাক্বারা (৪) : ৪)

[3] (সহীহ আল-জা-মিউস সাগীর অযিয়াদাতুহ ১৫৪৭নং)

[4] (বুখারী, মুসলিম, মিশকাতুল মাসাবীহ ৩২০২-৩২০৯নং)

[5] (ইরওয়াউল গালীল ১৯২৭নং)

[6] (সহীহ আবু দাউদ, আল্লামা আলবানী ১৮৬৫নং, নাসাঈ, মুসনাদে আহমদ১/৮০)

[7] (সহীহ আবু দাউদ ১৮৫১নং)

[8] (সহীহ আবু দাউদ ১৮৫৩)

[9] (সহীহুল জামে ২২৩৫নং)

[10] (সূরা স-দ (২৮) : ২৭)

[11] (ফাতাওয়াল মারআহ ১০৫-১০৯পৃঃ)

[12] (সূরা আন-নিসা (৪) : ৪)

[13] (ফিকহুস সুন্নাহ ২/১৪৯)

[14] (ফিকহুস সুন্নাহ ২/১৪৯-১৫০)

[15] (সূরা আল-বাক্বারা (২) : ২৩৬)

[16] (ফিকহুস সুন্নাহ ২/১৪৮)

[17] (সূরা আন-নিসা (৪) : ২০-২১)

[18] (সূরা আল-বাক্বারা (২) : ২৩৭)

[19] (ফিকহুস সুন্নাহ ২/১৫১-১৫২)

[20] (বুখারী, মিশকাতুল মাসাবীহ ৩২৭৪নং)

[21] (ফিকহুস সুন্নাহ ২/১৪৯)

[22] (মাজাল্লাতুল বহুসিল ইসলামিয়্যাহ ৬/২৬২)

[23] (মাজাল্লাতুল বহুসিল ইসলামিয়্যাহ ২৫/৪৭)

[24] (মিশকাতুল মাসাবীহ ৩০৪৭নং, ইরঃ ১৬৫৫নং)

[25] (সূরা আল-আ‘রাফ (৭) : ৩)

Post a Comment

If you learn something from our post please comment...

 
Top